বারদৌলি সত্যাগ্রহ।

বারদৌলি সত্যাগ্রহ।।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসের গুজরাটের সুরাট জেলার বারদৌলি তালুকে ১৩ টি স্থানে বল্লভভাই প্যাটেল এর নেতৃত্বে যে কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল তা বরদৌলি সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত।

প্রেক্ষাপট : বারদৌলি তালুকে অধিকাংশ জমির মালিক ছিলেন কুনবি পাতিদারেরা,তারা ‘উজালিপরাজ’ বা ‘সাদা মানুষ’ নামে পরিচিত ছিলেন।

এদের জমি চাষ করতো দুর্বল জনগোষ্ঠী ঋণদাসেরা যারা ‘কালিপরাজ’ বা ‘কালো মানুষ’ নামে পরিচিত ছিলেন। এরা মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ ছিলেন। উচ্চবর্ণের ‘উজালিপরাজদের’ জমিতে নিম্নবর্ণের ভূমিহীন ‘কালিপরাজ’রা বংশানুক্রমিক ভাবে যে বাধ্যতামূলক শ্রমদান করে শোষণ অত্যাচার এর ধারা মেনে চলত তাকে ‘হালি প্রথা’ বলা হত।

সুরাট ও বারদৌলি তালুকে গান্ধীজীর গঠনমূলক কর্মসূচিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে কোন কুনওয়ারজি মেহতা, কল্যাণজী মেহেতা, দয়ালজি দেশাই জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। যেমন বিদেশি বস্ত্র বয়কট, মদ্যপান বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কালিপরাজদের অবস্থার উন্নতির জন্য ছটি আশ্রম খোলা হয়েছিল। স্কুল স্থাপন করা হয়। গান্ধীজী ‘কালিপরাজদের’ ‘রানিপরাজ’ বা ‘অরণ্যের অধিবাসী’ বলে উল্লেখ করেন।অন্যদিকে মেহেতা ভাতৃদ্বয় গড়ে তোলেন ‘পাতিদার যুবক মণ্ডল’।শুধু তাই নয় কালিপরাজদের বেগার খাটানো, মহাজনদের শোষণ, অনগ্রসর শ্রেণির নারীদের ধর্ষণের তীব্র সমালোচনা করা হয়।

এইভাবে বারদৌলি তালুকে মেহেতা ভ্রাতৃদ্বয় জনকল্যাণমুখী কাজের দ্বারা গান্ধীজীর আদর্শ ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন অন্যদিকে শ্রেণী সমন্বয়ে বজায় রেখেছিলেন ।

এমত অবস্থায় হাজার ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ বন্যার ফলে বারদৌলি তালুকে ফসল নষ্ট হলে সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অথচ সরকার প্রথমে ৩০ শতাংশ পরে তা পরিবর্তিত করে ২১.৯৭ শতাংশ অর্থাৎ ২২ শতাংশ কর বৃদ্ধি করে। মূল্য রাশ পাওয়ায় পাতিদার কৃষকেরা আরও বিপাকে পড়ে গিয়েছিল।

এই অবস্থায় মেহেতা ভ্রাতৃদ্বয় বল্লভভাই প্যাটেল কে এই কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবার আহ্বান জানান। এবং আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে খাজনা বন্ধের কথা বলেন।

হাজার ১৯২৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে পাতিদার সম্মেলনে গান্ধী এবং প্যাটেল এর উপস্থিতিতে সরকারকে রাজস্ব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সরকার আন্দোলনকারীদের জমি ও গবাদিপশু বাজেয়াপ্ত করে ও আন্দোলন দমাতে পারেনি । উপরন্তু কালিপরাজদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কাছে টানতে বা বিভেদ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়।

প্যাটেল ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আবেদন-নিবেদন, ভজন, ভক্তিগীতি, ধর্মীয় আবেগ এর মাধ্যমে সর্বস্তরের কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ এবং উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছিলেন।

আঞ্চলিক ও সর্বভারতীয় পত্র-পত্রিকা গুলিতে বারদৌলি সত্যাগ্রহ নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি শুরু হয়। গান্ধীজী স্বয়ং ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ ও ‘নবজীবন’ পত্রিকায় এই আন্দোলন নিয়ে প্রচার চালান।

আমেদাবাদের বস্ত্র কারখানার শ্রমিকেরা বারদৌলি আন্দোলনকারীদের স্বপক্ষে এগিয়ে আসেন প্রায় তেরোশো টাকা চাঁদা তুলে দেন। এইসময় কমিউনিস্ট পরিচালিত গিরনি কামগড় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ বারদৌলি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। এতে সরকার বৃহত্তর আন্দোলনের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়ে।

ফলত লর্ড উইলিংডন পুলিশ ও মিলিটারি পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে তদন্ত কমিটি গঠন করেন এবং কৃষকদের বাজেয়াপ্ত জমি ফেরত দিয়ে দেন।

অবশেষে ‘ব্লুমফিল্ড ম্যাক্সওয়েল কমিটি’ খাজনার হার কমিয়ে 6.০৩ শতাংশ করে।অর্থাৎ পরিশেষে বারদৌলি সত্যাগ্রহের জয়ী হয়।

বৈশিষ্ট্য :

১) হিন্দু মুসলমান ঐক্য : হিন্দু কৃষকরা প্রভুর নামে মুসলিম কৃষকরা খোদার নামে শপথ নিতো। গীতা পাঠ হতো কবীরের ভজন গাওয়া হতো।

২) মহিলাদের অংশগ্রহণ : মিঠুবেন পেটিট, ভক্তিবা,মনিবেন প্যাটেল, সারদাবেন শাহ ও সারদা মেহেতা মতো বিশিষ্ট মহিলাদের পাশাপাশি অসংখ্য সাধারণ মহিলা অংশগ্রহণ করেছিলেন। মহিলারাই বল্লভভাই প্যাটেল কে সর্দার উপাধি কে ভূষিত করেন।

গুরুত্ব :

১) আঞ্চলিক আন্দোলন থেকে সর্বভারতীয় পরিচিতি লাভ :বারদৌলি সত্যাগ্রহ নিয়ে আঞ্চলিক এবং সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে ব্যাপক প্রচার একে সর্বভারতীয় পরিচিতি এবং মর্যাদা দান করেছিল।

২) কংগ্রেসের পুনরুত্থান :অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার পর বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলন কে ভর করে জাতীয় কংগ্রেস পুনরায় স্বমহিমায় নিজের শক্তি এবং মর্যাদা কে পুন:প্রতিষ্ঠা করেছিল। বলা ভালো আইন অমান্য আন্দোলনের ভিত্তিভূমি তৈরি করেছিল বারদৌলি সত্যাগ্রহ।

৩)সর্দার প্যাটেলের উত্থান : বারদৌলি সত্যাগ্রহের মাধ্যমে বল্লভভাই প্যাটেল শুধুমাত্র ‘সর্দার’ উপাধি পাননি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে একজন অতীব গুরুত্বপূর্ণ নেতার মর্যাদা লাভ করেন।

৪)গান্ধীজীর পুনরুত্থান : গান্ধীজীর কাছে বারদৌলি সত্যাগ্রহ কোন স্থানীয় সত্যাগ্রহ’ ছিল না বরং জুডিথ ব্রাউনের ভাষায় “a crucial demonstration of the road to Swaraj”।অসহযোগ সত্যাগ্রহের ব্যর্থতা স্মৃতিকে ভুলিয়ে গান্ধীজীকে পুনরায় স্বমহিমায় আন্দোলনের মূল স্রোত এনেছিল বারদৌলি সত্যাগ্রহ।

Last updated