ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন।।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে কৃষক আন্দোলন।।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পূর্বের গণআন্দোলন গুলোর তুলনায় ছিল অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত এবং হিংসাত্মক। কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা কারারুদ্ধ হলেও জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আঞ্চলিক নেতাদের তত্ত্বাবধানে শহরে এবং গ্রামে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষকরা ছিল অনেক বেশি প্রত্যয়ী এবং ঐক্যবদ্ধ। রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখালেখি এবং সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ উপন্যাসের আমরা কৃষকদের সংগ্রামী ভূমিকা কে খুঁজে পাই।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কৃষক আন্দোলনের চারটি মূল কেন্দ্র ছিল –

১) বিহার এবং যুক্তপ্রদেশ এর পূর্ব দিক ২) বাংলার মেদিনীপুর ৩) উড়িষ্যা ৪) মহারাষ্ট্র,গুজরাট।

বিহার : বিহারে কৃষক আন্দোলনের সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিয়েছিল কৃষাণ সভা। রাহুল সাংকৃত্যায়ন মন্তব্য করেছেন “প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব নেতা হয়ে উঠেছেন”।

# বিহারের সারণ জেলার জমিদার এবং মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিল সরকারি প্রতিবেদনে ওই অঞ্চলকে ‘Notoriously criminal district’ বলা হয়েছিল।

# মুঙ্গের, গয়া, রেওয়া জেলার কৃষকরা অতিরিক্ত কর বন্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।

# বিহারে ৮০ শতাংশের বেশি পুলিশ চৌকি শাসকের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। দ্রুত কৃষক বিদ্রোহ পশ্চিম বিহারে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখান থেকে বেনারস। বালিয়া জেলায় দশটি থানা আন্দোলনকারীদের দখলে চলে আসে।

# ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নাগাদ দক্ষিণ বিহারে ‘আজাদ দসতা’ নামে একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে ওঠে, যারা সরকারি অস্ত্রাগার, কোষাগার, থানা প্রভৃতি জায়গা আক্রমণ করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতো। এই বাহিনীতে নিচুতলার ভূমিহীন কৃষকরাই বেশি ছিল।

উড়িষ্যা : উড়িষ্যাতে কিষান সংঘ এবং প্রজা মণ্ডল গুলির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল।

# পুরী, কটক, বালেশ্বর এর মত উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে কৃষকরা ‘আসন্ন ধ্বংসের’ গুজবে মেতে ওঠে। প্রকাশ্যে আইন অস্বীকার করে। থানা গুলি থেকে বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়। চৌকিদারি কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়,জমিদারদের কাছারি বাড়ি আক্রমণ করে, মহাজনদের কাছ থেকে ধান কেড়ে নেয়।

# তালচের রাজ্যে ‘চাষি-মুলিয়া রাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয় যার মূলে ছিল স্বর্ণ রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন। সকলের জন্য খাদ্য বাসস্থান এবং বস্ত্রের দাবি তোলা হয়।

# কোরাপুরে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকেরা খাজনা বন্ধের আন্দোলন শুরু করে।

# মালকানগিরি ও নওরঙপুরে লক্ষণ নায়েকের নেতৃত্বে উপজাতি কৃষকেরা ঘোষণা করে ব্রিটিশ রাজ শেষ হয়ে আসছে, গান্ধীর রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।তাই বন কর দেবার প্রয়োজন নেই।

# উড়িষ্যার ঢেঙ্কানলে উচ্চবর্ণের ভূস্বামী কর্তৃক বলপূর্বক উপহার কর আদায়ের বিরুদ্ধে সমাজবাদী নেতা নবকৃষ্ণ চৌধুরীর নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়েছিল।

বাংলা : ভারত ছাড়ো আন্দোলন বাংলায় দিনাজপুর, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায়, ছড়িয়ে পড়েছিল তবে মূল কেন্দ্র ছিল মেদিনীপুর।

# সুতাহাটা, নন্দবাজার, গেঁওখালি, চৈতন্যপুর ইত্যাদি স্থানে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল।

# ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই ডিসেম্বর তমলুকে আন্দোলনকারীরা একটি সমান্তরাল সরকার গড়ে তোলে যার নাম হয় ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’।সতীশ সামন্ত, সুশীল ধাঁড়া,নীলমণি হাজরা প্রমুখের উদ্যোগে এই জাতীয় সরকার গড়ে ওঠে।এই জাতীয় সরকারের প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নাম ছিল ‘বিদ্যুৎ বাহিনী’ মহিলা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর নাম ছিল ‘ভগিনী সেনা’ এবং মুখপত্র ছিল ‘বিপ্লবী’।

# প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ১৬ ই ডিসেম্বর প্রায় ১৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। অথচ সরকারি উদাসীনতায় সাধারণ মানুষ এবং কৃষকরা তীব্রভাবে আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠেন।

# পটাশপুর থানা, খেজুরি থানা এলাকায় কৃষকরা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

গুজরাট ও মহারাষ্ট্র :

#গুজরাটের আমেদাবাদ, রাজকোট, পোরবন্দরে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিল।

#গুজরাটের সুরাট, খান্দেশ প্রভৃতি জেলায় কৃষকরা গেরিলা আক্রমণ চালায়।সুরাটে কৃষকরা রেলপথ অবরোধ করে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

# গুজরাটের ভারুচ জেলার জম্বুসর শহরটি কৃষক বিদ্রোহের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। সাঁতারায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সমান্তরাল জাতীয় সরকার’।

Last updated