হিন্দু পেট্রিয়ট

হিন্দু পেট্রিয়ট।

উনিশ শতকে কৃষক বিভিন্ন বিদ্রোহকে অধিকাংশ সংবাদপত্র এবং সাময়িকপত্র খুব একটা ভালো নজরে দেখেনি।সংবাদপত্র এবং সাময়িকপত্র গুলি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং জমিদার শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করত।তবে নীল বিদ্রোহে কৃষকদের প্রতি বাঙালী বুদ্ধিজীবী সহানুভূতি ছিল চোখে পড়ার মতো।নীল বিদ্রোহে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল তত্ত্ববো্ধিনী সহ অনেক সংবাদপত্র এবং সাময়িকপত্র।তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল হিন্দু পেট্রিয়ট। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের প্রত্যয়ী মনোভাব এবং ক্ষুরধার কলম হিন্দু পেট্রিয়টকে স্মরণীয় করে রেখেছে। সাপ্তাহিক ইংরেজি সংবাদপত্র হিসাবে হিন্দু পেট্রিয়ট প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ৬ই জানুয়ারি।

পত্রিকার স্বত্বাধিকারী ছিলেন মধুসূদন রায়। এবং সম্পাদক ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ।কলকাতার কলাকার স্ট্রিটের অবস্থিত মধুসূদন রায়ের প্রেস থেকে এটি প্রকাশিত হতো।প্রথম থেকে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে হরিশচন্দ্র তার দাদা হারাণচন্দ্রের নামে পত্রিকার স্বত্ব মধুসূদনের কাছ থেকে কিনে নিয়ে পত্রিকার সম্পাদক হন,যা মৃত্যুকাল অবধি টিকে ছিল।হরিশচন্দ্রের মৃত্যুর পর কালীপ্রসন্ন সিংহ হরিশচন্দ্রের কাছ স্ত্রীর কাছ থেকে পত্রিকার সমস্ত স্বত্ব কিনে সম্পাদনার দায়িত্ব গিরিশচন্দ্র ঘোষের হাতে তুলে দেন।১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে পত্রিকাটি দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পত্রিকাটি চালু ছিল।এই পত্রিকাটি শুরুর দিকে ছিল ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ এর মুখপত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।নীলচাষী সম্পর্কে মিশনারিদের এবং মিশনারি ও নীলকর বিরোধের আসল কারণ পত্রিকাটি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে।যোগেশচন্দ্র বাগল লিখেছিলেন “নীল হাঙ্গামার(১৮৫৯ খ্রিঃ) সময় হরিশচন্দ্রের গৃহ অতিথিশালায় পরিণত হইয়াছিল।এই সময় ‘পেট্রিয়ট’ নিয়মিত খরচ চালাইয়া তার বেতনের যাহা অবশিষ্ট থাকিত তৎসমুদয়ই নীলচাষীদের সেবায় ব্যয়িত হইত।”

বিদ্রোহ শুরু প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা দলে দলে কৃষক পেট্রিয়ট অফিসে পরামর্শ ও উপদেশের জন্য আসত।নীল কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অনেকে এখানে থেকে যেত।নীল কমিশনের রিপোর্টকে হিন্দু পেট্রিয়ট ‘পক্ষপাতহীন দলিল’ বলে মনে করত।নির্যাতিত প্রজা-পক্ষকে সমর্থনের জন্য হরিশচন্দ্রকে কখনও শুনতে হয়েছে অকথ্য গালিগালাজ আবার কখনও শুনতে হয়েছে অকথ্য গালিগালাজ আবার কখনও দাঁড়াতে হয়েছে আদালতের কাঠগড়ায়।১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে পত্রিকায় হরিশচন্দ্র ‘Indigo District’ বা ‘নীল-জেলা’ নামে একটি নতুন বিভাগ খুলে নিম্নবঙ্গের নীল সম্পর্কীয় খবরাখবর প্রকাশ করতে থাকে।হরিশচন্দ্রের আমলে হিন্দু পেট্রিয়ট ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ এর মুখপত্র ছিল না। ১৮৫৯ এ জমিদারদের স্বার্থ-বিরোধী ‘দশ আইন’ এর সমর্থনে হরিশচন্দ্রের ভূমিকা ছিল স্মরণীয়।অন্যদিকে ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ প্রস্তাবিত আইনের ঘোর বিরোধী ছিল।

এই পত্রিকা লর্ড ডালহৌসির দেশশাসন-নীতি কে আক্রমণ করেন।বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে সমর্থন করে জনমত গড়ে তোলে।হিন্দু পেট্রিয়ট নারী শিক্ষার সমর্থনে জনমত গড়ে তোলে।

অনেকক্ষেত্রে হিন্দু পেট্রিয়টের মানসিকতা ছিল শাসক-পন্থী।ফরাজি আন্দোলন এবং মহাবিদ্রোহকে পত্রিকা সমর্থন করেনি। ব্রিটিশ সরকারের কাছে দুদু মিঞাকে আটক হওয়ার খবরটি পত্রিকায় আনন্দের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়েছিল।

সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় হিন্দু পেট্রিয়ট এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে এবং সাঁওতাল এলাকায় সামরিক শাসনের তীব্র বিরোধিতা করে।হরিশচন্দ্র সাঁওতাল বিদ্রোহকে নিছক বর্বরতার প্রকাশ বলে মনে করত না।তার মতে স্ত্রী পুত্র নিয়ে বেচে থাকার তাগিদেই এই অভ্যুত্থান।কিছুদিন পরে বিদ্রোহের বিস্তার লক্ষ্য করে হরিশচন্দ্র শঙ্কিত হয়ে পড়েন।এই সময়কালে বিদ্রোহীদের অত্যাচারের কিছু অতিরঞ্জিত বিবরণ পত্রিকাটি প্রকাশ করে।কিন্তু কখনই অন্য পত্রিকার মতো প্রতি-হিংসাপরায়ণ ছিল না।

হরিশচন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্য ব্রিটিশ সরকার ফন্দি আঁটছিল।এই সময় হরিশচন্দ্র তার পত্রিকায় অর্চিবল্ড হিল কর্তৃক হরমণি নামে এক মহিলাকে হরণ এর সংবাদ প্রকাশ করলে হিল সাহেব হরিশচন্দ্রের বিরুদ্ধে দশ হাজার টাকা খেসারত দাবি করে মানহানি মামলা করে।এরপর থেকে হরিশচন্দ্রের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে।মাত্র ৩৭ বছর বয়সে হরিশচন্দ্র মারা যান। সমসাময়িক পত্রিকায় এ বিষয়ে লেখা হয় “নীল বানরে সোনার বাংলা করলে এবার ছারখার"

Last updated