বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ।

বিংশ শতাব্দীর সূচনায় পুরুষেরা তাগিদ অনুভব করেছিল রাজনৈতিক আন্দোলনে মহিলাদের ‘নারী জনোচিত’ অবদান কে সংযুক্ত করার। অন্যদিকে বাংলার নারীরাও বুঝতে পেরেছিলেন জাগতিক জীবনের সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে তারা আর নীরব অসহায় দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারেন না। বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে উচ্চবিত্ত মহিলারা রাজনৈতিক সংগঠন এবং আন্দোলনের আঙিনায় এসেছিলেন। যেমন

ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলনে ইলবার্ট বিল কে সমর্থন করে বেশকিছু ‘ভদ্রমহিলা’ ভাইসরয়কে স্বাক্ষর করে আবেদনপত্র পাঠান

১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ১০ জন মহিলা কংগ্রেসের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন।

১৮৯০ এরপর থেকে কংগ্রেসের প্রতিটি অধিবেশনে মহিলারা হয় পর্যবেক্ষক অথবা প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।তবে তারা মূলত স্বামী বা বাবার সঙ্গে অধিবেশনে উপস্থিত হতেন।

কিন্তু বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের শুধুমাত্র শিক্ষিত শহুরে বুদ্ধিজীবী পরিবারের মহিলারা নয় সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এমনকি গ্রামের মহিলারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

১৬ই অক্টোবর ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার দিনে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে বাঙালি মহিলারা ‘অরন্ধন ব্রত’ পালন করেন। মহিলারা রাখি বন্ধন এর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক ঐক্যকে মজবুত করা এবং বিদেশি দ্রব্য বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন তার মা স্বদেশী আদর্শ তারা এতটাই প্রভাবিত ছিলেন যে বাড়ির সমস্ত বিলাতি রন্ধনপাত্র নষ্ট করে ফেলেছিলেন।

প্রায় পাঁচশত মহিলা ফেডারেশন হলের উদ্বোধন উপলক্ষে সমবেত হয়েছিলেন।

মুর্শিদাবাদে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী গৃহে তার কন্যা গিরিজা দেবী ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ পাঠ করেন তার জন্য বহু নারীর সমাবেশ হয়েছিল।

বরিশালে মনোরমা বসু একটি মিছিলের নেতৃত্ব দেন।

খুলনাতে কালীপ্রসন্ন বিশারদ এর বক্তৃতা শুনে ও তার আহবানে নারীরা বিলাতি চুরি ও প্রসাধন ত্যাগ করেন।

‘রাখি বন্ধন’ উৎসবে মহিলারা স্বদেশী পণ্যের ব্যাপক ব্যবহারের শপথ নেন।পাশাপাশি স্বদেশী তহবিলে টাকা পয়সা এমনকি সোনার গয়না পর্যন্ত দান করেন। এই নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কুমুদিনী মিত্র, লীলাবতী মিত্র, নির্মলা সরকার, হেমাঙ্গিনী দাস।

বহু সম্ভ্রান্ত এমনকি জমিদার পরিবারের নারীরা স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করেন। নাটোরের মহারানী বিদেশি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান।নদীয়ার মঙ্গলগঞ্জ এর জমিদার লক্ষণচন্দ্র আশের বিধবা পত্নী,জলপাইগুড়ির অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত,ময়মনসিংহের পুণ্যলতা গুপ্ত,প্রমুখ নারীদের নাম করা যায়।

কলকাতায় প্রথম বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মহিলা সভা হয় মেরি কার্পেন্টার হলে।নাটোরের মহারানী গিরিবালা দেবী, ও শ্রীমতী অবলা বসুর উদ্যোগে প্রায় এক হাজার মহিলা বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও গ্রহণ এর শপথ নেন।

বাঙালি মহিলারা বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলম ধরেছিলেন। ১৯০৫ এর শুরুতেই ‘অন্তঃপুর’ পত্রিকা বাংলা বিভাজনের চক্রান্তের আভাস দিয়েছিল।আগস্ট মাসে বামাবোধিনী পত্রিকা তে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়। অক্টোবর একটি নাটক প্রকাশিত হয় এবং যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কুমুদিনী মিত্র সম্পাদিত ‘সুপ্রভাত’ বনলতা দেবী সম্পাদিত ‘অন্তঃপুর’ পত্রিকায় স্বদেশী শিল্প সংগঠনের নিয়মিত বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতো। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের মুসলিম নারী খায়রুন্নেসা তার ‘নবনূর’ পত্রিকায় “স্বদেশানুরাগ”গ নামে একটি লেখায় বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ করার আহ্বান জানান। এমন একটা সময় তিনি এই আহ্বান জানান যখন মুসলমানদের একাংশ স্বদেশী আন্দোলন থেকে বহুদূরে ছিল।

সরলা দেবী চৌধুরানী ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তুলেছিলেন ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ যেখানে স্বদেশী দ্রব্য বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার সম্পাদিত ভারতী পত্রিকাতে ‘মায়ের কৌটা’ স্থাপন করে জাতীয় ভাণ্ডার অর্থ সংগ্রহের কথা বলা হয়।

সরলা দেবী চৌধুরানী ও ভগিনী নিবেদিতা স্বদেশী ভাবধারার প্রসারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। বাঙালি যুবকদের মধ্যে শরীরচর্চার জন্য সরলাদেবী চৌধুরানী প্রতাপাদিত্য উৎসব’, ‘উদয়াদিত্য উৎসব’ চালু করেছিলেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সূচনা করেন ‘বীরাষ্টমী ব্রত’। আখড়া বা ব্যায়াম সমিতি গঠনের মাধ্যমে তিনি সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রক্ষা করে চলতেন। ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠিত ‘সুহৃদ সমিতি’র মত গুপ্ত সমিতির সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ‘

স্বদেশী আন্দোলনের সূত্র ধরে বাংলায় নারীদের মধ্যে অনেকেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন।

লাবণ্যপ্রভা দেবী স্বদেশী আন্দোলনের সময় তাঁর বিপ্লবী ভ্রাতার জন্য নিয়মিত পিস্তল এবং বিপ্লবের পত্রিকা সংগ্রহ ও বহন করার কাজ করতেন।

দুকড়িবালা দেবী বিপ্লবী নিবারণ ঘটক কে সাহায্য করার জন্য সাতটি মসার পিস্তল নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছিলেন।এর জন্য ১৯১৭ সালে তিনি গ্রেফতার হন এবং দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

ননীবালা দেবী তার ভাতুষ্পুত্র ও সশস্ত্র বিপ্লবী অমরেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায় ও আরও কয়েকজনকে আশ্রয় দেন। এই অপরাধে তার দু বছর কারাদণ্ড হয় এবং পুলিশ তার উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল।

ঢাকা জেলার আশালতা সেন স্বদেশী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে বিপ্লবী আদর্শ প্রচারে ভর্তি হয়েছিলেন।

শ্রী অরবিন্দের ভগিনী সরোজিনী দেবী ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আলিপুর বোমা মামলা চলাকালীন তার ভ্রাতার পক্ষে মামলা চালানোর জন্য অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

ময়মনসিংহের ক্ষীরোদাসুন্দরী দেবী বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তরের’ সদস্য হয়েছিলেন।

বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত কে গ্রেফতার করা হলে তার মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী কে নারী সমাজের তরফ থেকে হাজার ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ্যে সংবর্ধনা মানপত্র দেওয়া হয়।এই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন লীলাবতী মিত্র।

বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের ফাঁসির পর তার মরদেহ নিয়ে শোকযাত্রায় বিপুল সংখ্যক মহিলারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামিল হন।

বাংলার বাইরে ও স্বনামধন্য নারীরা বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন কে সমর্থন করেছিলেন।যেমন রমাবাই রানাডে, তনুভাই তারখুদে, পণ্ডিতা রামাবাঈ। এম.জি. রানাডের পত্নী রামাবাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ভারত মহিলা পরিষদ’ ও ‘সেবা সদন’।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ এই বিষয়ে আরো জানতে নীচের ভিডিওটি দেখুন ।

এবং চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন ।।

Last updated