জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন বা বেথুন সাহেব ।
জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন বা বেথুন সাহেব ।
Last updated
জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন বা বেথুন সাহেব ।
Last updated
উনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও নারীশিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিলেন ডেভিড হেয়ার ও বেথুন।ভারত দরদী বেথুন মাত্র তিন বছরে(১৮৪৮ খ্রিঃ-১৮৫১খ্রিঃ) ভারত তথা বাংলায় নারী শিক্ষার ভিত্তি রচনা করেছিলেন।বেথুনের সম্পূর্ণ নাম ছিল জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বীটন।বীটন শব্দটি বাঙালীর উচ্চারণ দোষে কালক্রমে বেথুন হয়ে গিয়েছে।বীটন এর পরিবর্তে আমি বহুল ব্যবহৃত বেথুন শব্দটি ব্যবহার করেছি।
বেথুন জন্মগ্রহন করেছিলেন স্কটল্যান্ডের ফিফ্ কাউন্টির বালফোর শহরে।এই বেথুন নামটি আসলে ফরাসি।উত্তর ফ্রান্সে বেথুন বলে একটি শহর আছে।বেথুন সাহেব এর পূর্বপুরুষরা এখানেই থাকতেন।বেথুনের মামা গিলবার্ট কংগলেটন পারিবারিক নাম বেথুন লাভ করেছিলেন।এইভাবে একটি স্কচ পরিবার ফরাসি নাম লাভ করে।
বেথুনের পিতা লে কর্নেল জন ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ছিলেন সেনা আধিকারিক।জিব্রাল্টা অধিকার যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়ে ছিলেন।বেথুনের মা ছিলেন বুদ্ধিমতী,সংস্কৃতি সম্পন্না এবং ধার্মিক।মায়ের কাছেই বেথুনের বাল্যশিক্ষা হয়েছিল।।জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বেথুন মায়ের কথা বলতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে যেতেন।
বেথুন ক্রেম্বিজের ট্রিনটি কলেজ থেকে স্নাতক হন। তিনি চতুর্থ র্যংলার হয়েছিলেন।গণিতশাস্ত্রে বেথুনের অসাধারণ বুৎপত্তি ছিল।তিনি ছিলেন ভাষাবিদ।বেথুন গ্রিক,লাতিন,ফরাসি,জার্মান,ইতালিয় ভাষা জানতেন।ইংরাজি সাহিত্য মূলত এলিজাবেথীয় সাহিত্যে তার জ্ঞান ছিল বিপুল।বেশ কিছু বিদেশী কবিতা তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।বেথুন গ্যালিলিও এবং কেপলার এই দুই বিশ্ববরেণ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীর ওপর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বেথুনের আইন জ্ঞানে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বড়লাটের আইন পরিষদের সদস্য সচিব করে ভারতে পাঠানো হয়। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বেথুনের কাউন্সিল অব এডুকেশন বা শিক্ষা পরিষদের সভাপতি পদ লাভ করেন।এদেশে এসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রভৃতি পণ্ডিতদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বেথুন এদেশের মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি বালিকা বিদ্যালয়
স্থাপন করেন।নেটিভ ফিমেল স্কুল বা হিন্দু ফিমেল স্কুল হিসেবে প্রথমে দক্ষিনারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সুকিয়া স্ট্রীটের বৈঠকখানার বাড়িতে আরম্ভ হয়েছিল।পরে হেদুয়ার পশ্চিমদিকের ভূমিতে বর্তমান বেথুন স্কুলের নির্মিত হয়েছিল।বেথুন এই বিদ্যালয়ের জন্য প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যায় করেছিলেন। বেথুনের জীবৎকালে এই বিদ্যালয় সরকারী সাহায্য ছাড়াই চলত।মাসিক ব্যায় ছিল প্রায় ৮০০ টাকা এর অধিকাংশ বেথুন নিজে বহন করতেন।তবে এই কাজে তিনি অকুণ্ঠ সাহায্য পেয়েছিলেন রামগোপাল ঘোষ,দক্ষিনারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখ ব্যক্তির।বেথুন স্কুলের প্রথম ২১ জন ছাত্রীর মধ্যে পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের কন্যা ভুবনমালা ও কুন্দমালা ছিলেন।বেথুনের স্কুল প্রতিষ্ঠা কলকাতায় প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কায় বেথুন সেকালের সমাজের গণ্যমান্য এমনকি বিদ্যোৎসাহী মানুষকে আমন্ত্রণ করেননি।হিন্দুসমাজের একটা অংশ বেথুনের উদ্যোগকে ভাল নজরে দেখেননি।তৎকালীন বিখ্যাত কবি ঈশ্বরগুপ্ত তার কবিতায় লেখেন-
“আগে মেয়েগুলো ছিল ভালো
ব্রতকর্ম করতো সবে,
একা ‘বেথুন’ এসে শেষ করেছে
আরকি তাকে তেমন পাবে।”
শিবনাথ শাস্ত্রী তার ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন “ ১৮৪৯ সালের ৭ই মে দিবসে তন্নাম প্রসিদ্ধ বালিকা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।বীটন এই কর্যে দেহ-মন-প্রাণ নিয়োগ করেন।হেয়ার যেমন বালকদিগের শিক্ষা লইয়া মাতিয়াছিলেন,বীটন তেমনি বালিকাদের শিক্ষা লইয়া মাতিয়া যান।তিনি সর্বদাই তাহার নবপ্রতিষ্ঠিত স্কুল পরিদর্শন করিতে আসিতেন।আসিবার সময় বালিকাদিগের জন্য নানা উপহার লইয়া আসিতেন।মধ্যে মধ্যে বালিকাদিগের নিজ ভবনে লইয়া গিয়া মূল্যবান উপহার সামগ্রী দিয়া গৃহে প্রেরণ করিতেন।। ......”
বেথুনে উদ্দেশ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রদান করা এবং শিক্ষার মাধ্যম করতে চেয়েছিলেন মাতৃভাষাকে।প্রথাগত শিক্ষাদানের পাশাপাশি সূচিশিল্প,এমব্রয়ডারি,অঙ্কনবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষাদানের কথা তিনি ঘোষণা করেন।
বেথুন সর্বদা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে বেথুন তার বিদ্যায়তনের ভিত্তি স্থাপন পর্বে যে ভাষণ দেন ,তাতে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দানের ওপর গুরুত্ব দেন। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ’(vernacular translation society) স্থাপিত হয়েছিল। চোদ্দ জন সদস্য বিশিষ্ট এই সভার অধ্যক্ষ ছিলেন স্বয়ং বেথুন। ‘বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ’ এর আনুকূল্যে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায় ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া ‘রবিন্সন ক্রুসো’,ছোট কৈলাস এবং বড় কৈলাস’ ‘সুশীলার উপাখ্যান’ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছিল।
বেথুনের মৃত্যুর পর তার স্মৃতিরক্ষার জন্য তার নামে বেথুন সোসাইটি স্থাপন করা হয়।চল্লিশ বছর এর আয়ু ছিল।এই সোসাইটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন জেমস লঙ,কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়,বিদ্যাসাগর প্রমুখ ব্যক্তি।জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তৎকালীন বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা এই সোসাইটিতে মুক্ত মনে আলোচনা করতেন।
অতিরিক্ত শ্রম,অতিরিক্ত চিন্তায় বেথুনের আয়ু সংকীর্ণ হয়ে এসেছিল।যকৃৎ এর কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ১২ই আগস্ট তিনি পরলোক গ্রহণ করেন।কোলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডের নতুন সমাধিক্ষেত্রে তার দেহ সমাধিস্থ করা হয়।