আনন্দমঠ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম দিকের উপন্যাসগুলির পটভূমি ছিল সমাজ জীবন ।পরের দিকে ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘সীতারাম’ ইত্যাদি উপন্যাসগুলির পটভূমি ছিল ইতিহাস এবং রাজনীতি ।

বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বাদশ উপন্যাস আনন্দমঠকে তাঁর প্রথম রাজনৈতিক উপন্যাস বলা যায় শুধু তাই নয় এটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী উপন্যাস ।ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায় “আর কোনও বাংলা বই বা অন্য কোনও ভাষায় কোনও বই বাঙালি যুবকদের এর গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেনি”।

রচনাকাল:

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার আনন্দমঠ উপন্যাসটি ‘বঙ্গদর্শন’ পরিকায় ধারাবাহিকভাবে বাংলা ১২৮৭ বঙ্গাব্দে চৈত্রমাস ইংরেজি মাসের হিসেবে ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে লেখা শুরু করেন।

অবশেষে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং বঙ্কিমচন্দ্র এই গ্রন্থ উৎসর্গ করেন তার প্রয়াত বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রকে।

পটভূমি:

আনন্দমঠ উপন্যাসটি মূলত একদিকে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, অন্যদিকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত ।

পদচিহ্ন গ্রামের সম্ভ্রান্ত দম্পতি মহেন্দ্র সিং এবং তার স্ত্রী কল্যাণী দেবী ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে হৃত সর্বস্ব হয়ে পেটের দায়ে শহরের পথে পা বাড়ায়।কিন্তু ঘটনাচক্রে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কল্যাণী তার শিশুকন্যাকে নিয়ে বনমধ্যে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন ।

সেই সময় গভীর অরণ্যে স্বামী সত্যানন্দ তাদের উদ্ধার করেন ।অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে মহেন্দ্র ও কল্যাণীর মিলন ঘটে।ইতিমধ্যে মহেন্দ্র স্বয়ং স্বামী সত্যানন্দের শিষ্যত্ব ও সন্তান দলের সদস্য হন ।

স্বামী সত্যানন্দ ম্লেচ্ছ যবনদের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসীদের ঐক্যবদ্ধ করে সন্তান দল গড়ে তোলেন এবং অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন ।গভীর অরণ্যে স্বামী সত্যানন্দ তার শিষ্যরা ভবানন্দ,জীবানন্দ,আশ্রম তৈরি করে সংগ্রামের জন্য ‘অনুশীলন’ শুরু করেন।তারা আশ্রমে মাতৃ মূর্তি যা তাদের কাছে দেশ জননী তার প্রতিষ্ঠা করেন ।সন্তান দল বঙ্গ জননীর লুপ্ত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে ব্রতী হয়েছিলেন।

অনেকের মতে বঙ্কিমচন্দ্র এই উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে ওয়াল্টার স্কটের লেখা ‘ওল্ড মরটালিটি’ উপন্যাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।স্কটের উপন্যাসে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকালে ‘কভেনান্টার’ নামে স্কটল্যান্ডের সন্ন্যাসী সম্প্রদায় ইংল্যান্ডের রাজশক্তির বিরুদ্ধে শামিল হয়েছিল ।

বন্দেমাতরম গানের সংযোজন -

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বন্দেমাতরম গানটি লিখেছিলেন তার বঙ্গদর্শন পত্রিকায় পরে সুরেন্দ্রনাথের অনুরোধে তিনি দেবী দুর্গার বন্দনা গীতি হিসেবে আনন্দমঠ উপন্যাসে সংযোজিত করেন ।

উপন্যাসের শেষদিকে গোরা সৈন্যরা যখন কামান দাগছে তখন তার মধ্যে দিয়ে দেশপ্রেমিক ‘সন্তান দল’ বন্দেমাতরম গেয়ে এগিয়ে চলেছে ।

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে শ্রী অরবিন্দ ‘Mother I bow to thee’ শিরোনামে গানটির ইংরেজি অনুবাদ করেন ।

প্রখ্যাত সুরকার যদু ভট্ট বন্দেমাতরম গানের সুরারোপ করেন ।

১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং এই গানটির পরিবেশন করেন।

ভিখাজী রুস্তম কামা ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা তৈরির সময় দেবনাগরী অক্ষরে বন্দেমাতরম শব্দটি ব্যবহার করেন ।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে মূলত বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে স্বদেশী প্রচারকরা বিপ্লবীদের কাছে বন্দেমাতরম বেদমন্ত্রে পরিণত হয়।শত শত কণ্ঠে উচ্চারিত বন্দেমাতরম ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিল ।

ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে আনন্দমঠ উপন্যাসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং বন্দেমাতরম ধ্বনির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর ভারত স্বাধীন হলে সংবিধান মোতাবেক ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতটিকে ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হয়।

আনন্দমঠের স্বদেশপ্রেম ।

আনন্দমঠে স্বামী সত্যানন্দ দেশবাসীকে শোনান “দেশমাতা হলেন মা, দেশপ্রেম হল ধর্ম এবং দেশসেবা হল পূজা”

দেশ নিছক জড় বস্তু নয়,দেশ আমাদের মা ।স্বামী সত্যানন্দ বলেছেন “ আমারা অন্য মা মানি না – জননী জন্মভূমিশ্চ স্বার্গাদপী গরীয়সী, আমরা বলি জন্মভূমিই জননী,আমাদের মা নাই,বাপ নাই,ভাই নাই,বন্ধু নাই,পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ি নাই, আমাদের আছে কেবল সেই সুজলা,সুফলা,মলয়জ সমীরণ শীতলা শস্যশ্যামলা ‘মা’”

দেশপ্রেমই ধর্ম এবং ধর্মই দেশপ্রেম এই ধর্মের নাম সন্তান ধর্ম।

বনে জঙ্গলে গিয়ে আত্মার মুক্তি নয়,সন্ন্যাসীর মূল লক্ষ্য মানুষের মুক্তি,দেশের মুক্তি।

আবেদন নিবেদন নয় বরং ক্ষাত্র শক্তি ও আত্মদানের মাধ্যমে দেশমাতৃকার মুক্তি হবে।

নীতি হীন হলে দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না । দেশপ্রেমিক নিষ্কাম্ভাবে কাজ করবেন ।

বঙ্কিম দেশকে মা হিসেবে দেখেছেন এবং সেই দেশমাতৃকার তিনটি রূপকে বঙ্কিম তার আনন্দমঠ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন সত্যানন্দের মাধ্যমে।

মা যা ছিলেন- ‘সর্ব আররণভূষিতা জগদ্ধাত্রী’

মা যা হইয়াছেন – অন্ধকার সমাচ্ছন্না কালিমাময়ী কালীরূপিনী/যেহেতু মন্বন্তরে দেশ শ্মশান তাই মা কালী কঙ্কালমালিনী।

মা যা হইবেন –‘সুবর্ণনির্মিত দশভুজা দশ প্রহরণধারিণী দেবী দুর্গা,।

আনন্দমঠের প্রভাব:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন যে তিনটি গ্রন্থের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা অপরিসীম তা হল শ্রীকৃষ্ণের ‘গীতা’,বিবেকানন্দের ‘রচনাবলী’,বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ।

অরবিন্দ বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘স্বদেশিকতার গুরু’আখ্যা দিয়েছেন। আনন্দমঠের অনুপ্রেরণায় তিনি লিখেছিলেন ‘ভবানী মন্দির’।

বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি অনুশীলন সমিতি নামটি গ্রহণ করেছিলেন আনন্দমঠের অনুশীলন তত্ত্ব থেকে। অনুশীলন সমিতির সদস্যদের কাছে আনন্দমঠ ছিল সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের গীতা ।

এই উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদ হয়েছিল ‘ The Abbey of Bliss’ নামে ।দ্রুত হিন্দি,তামিল,তেলেগু সহ ভারতীয় এবং অন্য বিদেশী ভাষায় অনুদিত হয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল খুব কম সময়ে।

ভিডিও লেকচার দেখার জন্য নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন ।

Last updated