দীনবন্ধু মিত্র ও ‘নীলদর্পণ’
Last updated
Last updated
দীনবন্ধু মিত্র ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে (১২৩৬ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে বৃহত্তর যশোর জেলার বনগ্রাম মহকুমার (বর্তমান চব্বিশ পরগনা জেলার ) কাঁচরাপাড়া ষ্টেশনের কাছে চৌবাড়িয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। গ্রামটির চারদিকে নদী বলে এর নাম চৌবাড়িয়া।তার পিতা কালাচাঁদ মিত্র ছিলেন সম্পন্ন কৃষক।কালাচাঁদ মিত্রের ছয় পুত্রের মধ্যে দীনবন্ধু ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।দীনবন্ধু মিত্রের পিতৃদত্ত নাম হল গন্ধর্ব নারায়ণ। ছাত্র জীবনে তিনি পিতৃদত্ত নাম পরিত্যাগ করে দীনবন্ধু নাম গ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি পাঠশালায় লেখাপড়া আরম্ভ করেন এবং তা সমাপ্ত হলে তার পিতা তাকে জমিদারির সেরেস্তায় অতি সামান্য বেতনে নিযুক্ত করে দেন। কিন্তু বালক দীনবন্ধুর কিছুতেই চাকুরীতে মন টিকল না। তিনি পিতার কথায় অবাধ্য হয়ে চাকুরী ছেড়ে কলিকাতায় চলে আসেন।সম্ভবত ১৮৪৬ খৃষ্টাব্দে প্রায় ষোল বছর বয়সে তিনি লঙ সাহেবের অবৈতনিক ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন।এর পরেই তিনি কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৪৭ খৃষ্টাব্দে এ স্কুলের নাম হয় হেয়ার স্কুল। ১৮৫০ খৃষ্টাব্দে তিনি স্কুলের শেষ পরীক্ষায় জুনিয়র বৃত্তি প্রাপ্ত হয়ে হিন্দু কলেজে চতুর্থ শ্রেণীতে (প্রথম বর্ষ) ভর্তি হলেন। তবে ১১ শে জানুয়ারি শিক্ষকতা কর্মের পরীক্ষায় তিনি তিরিশ টাকা বৃত্তি লাভ করে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত হন। ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দে তিনি কলেজের শেষ পরীক্ষা না দিয়ে পাঠ অসম্পূর্ণ রেখেই ১৫৫ টাকা বেতনে পাটনার পোষ্টমাষ্টার পদে চাকুরীতে যোগ দান করেন। ডাক বিভাগে চাকুরী গ্রহণ করার পূর্বে তিনি স্বল্প কালের জন্য কলকাতার হিন্দু কলেজে শিক্ষকতার কাজ গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। ডাক বিভাগের পদে তিনি অত্যন্ত সু-খ্যাতির সাথে দেড় বছর কাজ করেন। কর্মকুশলতার জন্য অল্প দিনের মধ্যে তিনি উড়িষ্যা বিভাগে পোস্টাল পরিদর্শক পদে উন্নীত হয়। তার কাজ ছিল তদারক ও তত্ত্বাবধানের। বঙ্কিমচন্দ্র তার সম্পর্কে লিখেছেন- “উড়িষ্যা বিভাগ হইতে দীনবন্ধু নদীয়া বিভাগে প্রেরিত হয়েন ......।এই সময়ে নীল বিষয়ক গোলযোগ উপস্থিত হয়।দীনবন্ধু নানা স্থানে পরিভ্রমণ করিয়া নীলকরদিগের দৌরাত্ম বিশেষভাবে অবগত হইয়াছিলেন। তিনি এই সময়ে নীলদর্পন (নাটক) প্রণয়ন করিয়া বঙ্গীয় প্রজাগনকে অপরিশোধনীয় ঋণে বদ্ধ করিলেন......।” লুসাই যুদ্ধের সময় তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইংরেজদের বিপর্যয় যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করেছিলেন। ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ সরকার তাকে বাহাদুর উপাধি দেয়।বঙ্কিমচন্দ্র এ সম্পর্কে খেদ প্রকাশ করে বলেছেন “ দীন বন্ধুর সেরূপ কার্য্যদক্ষতা এবং বহুদর্শিতা ছিল তাহাতে তিনি যদি বাঙালী না হইতেন তাহা হইলেন মৃত্যুর অনেক দিন পুবেই তিনি পোস্টমাস্টার জেনারেল হইতেন এবং কালে ডাইরেক্টর জেনারেল হইতেন।”
১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে তিনি ২৫ বৎসর বয়সে বাঁশবেড়িয়ার (বংশবাটা) সংকার বংশের কালিদাস মহাশয়ের কন্যা অন্নদাসুন্দরীকে বিবাহ করেন।পারিবারিক জীবনে তিনি আট সন্তানের জনক ছিলেন।দীনবন্ধু মিত্র শেষ জীবনে অশেষ শারীরিক কষ্ট ভোগ করেছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে তাকে বারবার বদলী হতে হয়েছে। সরকারের এই ধরনের অমানবিক নিষ্ঠরতার জন্য তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়তে থাকে। তিনি অনেক দিন দুরারোগ্য বহুমূত্র রোগে ভুগে ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দের ১ লা নভেম্বর তারিখে তেতাল্লিশ বৎসর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ইতিহাস এবং সাহিত্যপ্রেমীরা দীনবন্ধু মিত্রকে মনে রেখেছেন তার সাহিত্যকর্মের জন্য।আরও বলা ভাল তিনি বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব লাভ করেছেন তার ‘নীলদর্পণ’
নাটকের জন্য।দীনবন্ধু মিত্রের প্রকাশিত গ্রন্থগুলি ‘নীলদর্পণ’(নাটক ১৮৬০) ।‘নবীন তপস্বিনী’(নাটক ১৮৬৩)।‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’(প্রহসন ১৮৬৬)। ‘সধবার একাদেশী’(নাটক ১৮৬৬)। ‘লীলাবতী’(নাটক ১৮৬৭ )। ‘সুরধনী কাব্য’( পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত কাহিনী কাব্য ১৮৭১)। ‘জামাই বারিক’(প্রহসন ১৮৭২)। ‘দ্বাদশ কবিতা’(কাব্যগ্রন্থ ১৮৭২)।‘কমলে কামিনী’ (নাটক ১৮৭৩)। ‘সুরধনী’(কাব্যগ্রন্থ – ১৮৭২)।‘পদ্যসংগ্রহ’(১৮৮৬)।‘নানা কবিতা’ । ‘কুড়ে গরুর ভিন্ন গোঠ’(নাট্যচিত্র)।‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’(উপন্যাস ) ‘পোড়ামহেশ্বর’(গল্প)।
‘নীলদর্পণ’
১৮৬০ খৃষ্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্র এদেশের কৃষকদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনী অবলম্বনে ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনা করেন।এ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র বলেন-“দীনবন্ধু বিলক্ষণ জানিতেন যে তিনি যে নীল দর্পণের প্রণেতা , ইহা ব্যক্ত হইলে তাহার অনিষ্ট ঘটিবার সম্ভাবনা। যে সকল ইংরাজের অধীন হইয়া তিনি কর্ম করিতেন তাহা্রা নীলকরের সুহৃদ। বিশেষ পোষ্ট অপিসের কার্য্যে নীলকর প্রভৃতি অনেক ইংরাজের সংস্পর্শে সর্ব্বদা আসিতে হয় তাহারা শত্রুতা করিলে বিশেষ অনিষ্ট করিতে পারুক আর না পারুক সর্ব্বদা উদ্বিগ্ন করিতে পারে এ সকল জানিয়াও দীনবন্ধু নীলদর্পন প্রচারে পরাম্মুখ হয়েন নাই। নীলদর্পনে গ্রন্থকারের নাম ছিল না বটে কিন্তু গ্রন্থকারের নাম গোপন করিবার জন্য দীনবন্ধু অন্য কোন প্রকার যত্ন করেন নাই। নীলদর্পন প্রচারের পরেই বঙ্গদেশের সকল লোকেই কোন প্রকারে না কোন প্রকারে জানিয়াছিল যে, দীনবন্ধুই ইহার প্রণেতা।”
রাজা রামমোহন রায় ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ১৫ই ডিসেম্বর কলকাতায় টাউন হলে যে বক্তব্য রাখেন তাতে নীলকর সাহেবদের ভূমিকাকে হালকা করে দেখানো হয়।অনেক পত্রিকা নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনীকে এড়িয়ে যায়।বঙ্গদূত পত্রিকা নীলকরদের নিজস্ব মুখপত্র হয়ে উঠেছিল।১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে বেন্টিঙ্ক কুখ্যাত পঞ্চম আইন প্রণয়ন করে কৃষকদের নীলচাষী করতে বাধ্য করলে অনেকে প্রতিবাদে সোচ্চার হন।অক্ষয়কুমার দত্ত ‘তত্ববোধিনী পত্রিকা’এ প্রথম নীলচাষীদের মর্মপীড়া তুলে ধরেন।হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদে সোচ্চার হন।তবে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ একদিকে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার অন্যদিকে অসহায় কৃষকদের করুন জীবন সংগ্রামের আলেখ্যকে তুলে ধরেছিল।দীনবন্ধু জন্মসূত্র ও কর্মসূত্রে নদীয়া এবং যশোরের মানুষদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।এই অঞ্চলগুলিতে নীলের চাষ হতো।দীনবন্ধু উড়িষ্যা থেকে নদীয়ায় বদলি হন।এই সময়ে নীলের হাঙ্গামা হয়।তিনি এই সব হাঙ্গামা প্রত্যক্ষ করেন।এই গুলিই ‘নীলদর্পণ’ প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘দীনবন্ধু পরের দুঃখে নিতান্ত কাতর হইতেন।নীলদর্পণ এই গুণের ফল।’
১৮৫৮-১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি রচনা করেন। এটি প্রকাশিত হয় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে।এই নাটকে যশোরের নীলকুঠির ম্যানেজার আর্কিবল্ড সাহেবের কুকীর্তি বর্ণনা করা হয়েছে।যার কাজ ছিল নীলচাষীদের ওপর অত্যাচার করা,নারী হরণ এবং নারীর ওপর অত্যাচার করা।যেহেতু দীনবন্ধু ছিলেন ডাকবিভাগ উচ্চপদস্থ কর্মী তাই সরকারী রোষানলের ভয়ে ‘কস্যচিৎ পথিকস্য’ (জনৈক পথিকের)এই ছদ্মনামে নাটকটি প্রকাশ করেন।
নদীয়ার অন্তর্গত গুয়াতালির মিত্র পরিবারের বিপর্যয়ের কাহিনীকে কেন্দ্র করে ‘নীলদর্পণ’ রচিত হয়েছিল।এই নাটকে আবু তোরাপ, আদুরী, উড-সাহেব, পদীময়রানি, ক্ষেত্রমণি, রাইচরন,সাধুচরণ,গো্পীনাথ চরিত্র গুলি অত্যন্ত জীবন্ত। এই নাটকে গোলক বসু, নবীনমাধব,বিন্দু মাধব,সৌরিন্ধ্রী,সাবিত্রী প্রভৃতি চরিত্রের মধ্য দিয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সামাজিক মানসিকতা ধরা পড়ছিল।গোলক বসুর সহজ বিশ্বাস,নবীন মাধবের কর্তব্যবোধ ও পিতৃভক্তি,সৌরিন্ধ্রীর পতিব্রতা,সাবিত্রীর অপত্যস্নেহ বাঙালী সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছিল।এই নাটকে প্রধান চরিত্রগুলি মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং সম্পন্ন কৃষক পরিবার থেকে গৃহীত হয়েছে। আবুতোরাপ ও নবীনমাধব এর সুসম্পর্ক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্র তুলে ধরেছে।নাটকে যে বিদেশী চরিত্রগুলি দেখানো হয়েছে সেগুলি অতিরঞ্জিত হলেও তখনকার ইংরেজ সম্প্রদায়ের যথার্থ প্রতিনিধি,এদের অনেকেই সত্য চরিত্র অবলম্বনে পরিকল্পিত হয়েছে।
‘নীলদর্পণ’ সম্ভবত প্রথম বাংলা নাটক যা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন রেভারেন্ড জেমস লঙে।অনুদিত ‘নীলদর্পণ’ সেইসময়ে স্বদেশে এবং বিদেশে যথেষ্ট চাঞ্চল্য সৃস্টি করেছিল।ইংরেজ কোম্পানী এবং নীলকরদের অত্যাচার বেআব্রু হয়ে পরে।রেভারেন্ড জেমস লঙকে রাজদ্রোহের অপরাধে কারারুদ্ধ করা হয় এবং জরিমানা করা হয়।‘নীলদর্পণ’ প্রকাশের জন্য সরকার রেভারেন্ড জেমস লঙকে যে অর্থদন্ড দেন, সেই অর্থ কালীপ্রসন্ন দান করেন।
কলকাতায় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল থিয়েটারে পেশাদারী নাটক হিসাবে অভিনীত হয়।এরপর থেকে এটি জনসাধারণের নাটকে পরিণত হয়।বলাবাহুল্য দীনবন্ধুর নাটক দিয়ে সাধারণ নাট্যশালার পথচলা শুরু হয়েছিল।আঞ্চলিক ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার,ছড়া, প্রবাদ এবং ইংরেজি কবিতার প্রয়োগ এই নাটককে মঞ্চে দারুণ জনপ্রিয়তা দিয়েছিল।গিরিশচন্দ্র পরিচালিত ন্যাশনাল থিয়েটারে মেয়ো হাসপাতালের সাহায্যার্থে টাউন হলে ‘নীলদর্পণ’ মঞ্চস্থ হয়।এই অভিনয়ে গিরিশচন্দ্র উড সাহেবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।দীনবন্ধুর অভিন্ন হৃদয়বন্ধু বঙ্কিম এই নাটককে মার্কিন লেখক হ্যারিয়ট রিচার স্টোর লেখা ‘আঙ্কল টমস কেবিন’ এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তবে ‘নীলদর্পণ’ কেবল নীলকরদের সাময়িক উৎপীড়নের কাহিনী নয়।এর মধ্যের দীনদুঃখীর প্রাত্যহিক পল্লী জীবনের যে নিখুঁত ও করুণ বাস্তব অনুভূতি ও সমবেদনায় অঙ্কিত হয়েছে এবং তার দ্বারা যে সনাতন জীবন-সত্য প্রাণবন্ত ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে কেবল তার একটি চিরন্তন সাহিত্যিক মূল্য আছে।।নানাদিক থেকে নীলদর্পণ বাংলা নাটকে ও নাট্যশালার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।এই নাটকে প্রথম আমরা রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অগ্নি-জ্বালাময় রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম।অর্থনৈতিক শোষণের বাস্তব চিত্র এই প্রথম কোন বাংলা নাটকে তুলে ধরা হলো।এই প্রথম আঞ্চলিক ভাষায় কৃষক জীবনের মৃত্তিকাশ্রিত বাস্তবরূপ উদ্ঘাটিত হলো।এই নাটকে নাট্যকারের সামগ্রিক পরিকল্পনা,জীবনবোধ ও শিল্পচেতনা সঙ্গে এক অকৃত্রিম ও অখণ্ড বাস্তব রসবোধ ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে।