খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস
Last updated
Last updated
মানুষ খাদ্য-সংগ্রহকারী থেকে খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র্য এসেছিল। আদিম মানুষ শুরুর দিকে কাঁচা খাবার ও মাংস খেত। ক্রমে আগুন পুড়িয়ে পরে জলে সেদ্ধ করে এবং সবার শেষে তেলে ভেজে মানুষ নানা ধরণের খাবার তৈরি করেছিল। তবে একথা ঠিক কোনও অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পেছনে থাকে তার ভৌগলিক ও জলবায়ুগত প্রভাব, খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং সংরক্ষণের সুযোগ।তবে খাদ্যাভ্যাসের পেছনে সংস্কার, রীতিনীতি এবং পরম্পরা অন্যতম প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। যেমন আমাদের মধ্যে আমিষ ও নিরামিষ খাদ্য বা মাংসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে রুচিগত পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ ।
কাঁচা – পোড়া- সেদ্ধ- ভাজা ।
খাদ্যাভ্যাসের প্রেরণা ।
গ্রীক ও রোমান পর্যটকদের বিবরণে জানা যায় গঙ্গারিডি অঞ্চলে প্রাচীন বঙ্গে ধান, গম,যব, আখ চাষের পাশাপাশি সরষে কলাইয়ের তৈরি নানা ধরণের খাদ্য তৈরি হতো ।তাছাড়া নারকেল চাষ হতো ।তাছাড়া প্লিনি ও পেরিপ্লাসের লেখায় নানা ধরনের মশলা ও সুগন্ধির কথা বলা আছে ।ভারতচন্দ্র তার বিখ্যাত অন্নদামঙ্গল কাব্যে ব্রাহ্মণ ভোজনের যে বিররণ দিয়েছেন তাতে নিরামিষ, আমিষ, অম্লমধুর,তিক্ত-কষা কোন কিছুই বাদ নেই ।
মধ্যযুগে বাঙ্গালীর খাদ্যাভ্যাসে ইন্দো-পারসিক রুচির সমন্বয় ঘটেছিল ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরিফউদ্দিন আহমেদ দেখিয়েছেন মধ্যযুগে প্রাদেশিক রাজধানী রূপে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পর বাংলার পূর্বাঞ্চলের নিজস্ব রন্ধন প্রণালীর সঙ্গে পারসিক খাদ্যরীতির সংমিশ্রণে ঢাকাই খাবারের উৎপত্তি হয়েছিল ।
আধুনিক যুগের গোড়ায় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির খাদ্যভাস ভারতীয় খাবারকে প্রভাবিত করেছিল ।সকালের প্রাতরাশ ব্যাপারটাই বদলে গিয়েছিল ।চা,বিস্কুট,পাউরুটি ইত্যাদি খাদ্য বাঙালির তথা ভারতীয়রা পেয়েছিল বিদেশীদের থেকে । পর্তুগিজদের হাত ধরে আলুর ব্যবহার শিখেছিল । বাংলার মিষ্টান্ন তৈরিতে মূলত ক্ষীর ও খোয়া ব্যবহৃত হতো । কিন্তু পর্তুগিজ প্রভাবে বাঙালি দুধকাটা ছানার মিষ্টি তৈরি করেছিল ।এইভাবে রসগোল্লা, সন্দেশের উদ্ভব হয়েছিল ।হুগলী জেলায় পর্তুগিজ প্রভাবে মিষ্টি তৈরিতে ছানার ব্যবহার শুরু হয় ।
এবার আমরা আলোচনা করব উনিশ শতক নিয়ে । উনিশ শতকেই প্রথম বাংলার খাদ্যপ্রনালী, রন্ধন চর্চা নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল । বিভিন্ন সাময়িকপত্রে রান্নার রেসিপি নিয়ে লেখা ছাপা হতো । বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম রান্নার বই ছিল দুটি । ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কার ভট্টাচার্যের ‘পাক্ রাজেশ্বর’ ১৮৫৮ সালে গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’ ।তবে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করছিল বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘ পাক-প্রণালী’ ।পুরুষদের পাশাপাশি বাঙালি ‘ভদ্রমহিলা’রাও রান্নার বই লিখতে শুরু করেন ।রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী এবং ‘পুণ্য’ পত্রিকার সম্পাদিকা লেখেন ‘আমিষ ও নিরামিষ’ নামে একটি বই । কিরণরেখা রায় লেখেন ‘বরেন্দ্র রন্ধন’ । রেনুকাদেবী চৌধুরানী লিখেছিলেন ‘রকমারি নিরামিষ রান্না’ আর ‘আমিষ খণ্ড’ ।
মজার কথা উপরিউক্ত সব বইগুলোতে নিরামিষ রান্নার পাশাপাশি ফলাও করে প্রচুর আমিষ রান্না এমনকি মাংস রান্নার রকমারি পদের ছড়াছড়ি ।অথচ মাংসাশী এই বাঙালীকে ইংরেজ সাহেবরা ‘ভেতো’ ও ‘ভীরু’ বলে পরিচয় দিতেন। আসলে উনিশ শতকে আমিষ ও নিরামিষ প্রশ্নকে নিয়ে বাঙালি তথা ভারতীয় সমাজ ছিল দ্বিধাবিভক্ত । অনেকটা এইরকম যে পাশ্চাত্য হল আমিষ আহার অর্থাৎ বন্য এবং হিংস্র অন্যদিকে প্রাচ্য হলো নিরামিষ আহার সত্য এবং শান্ত ।
তবে এই উদীয়মান জাতীয়তাবাদের হাত ধরে অনেকেই আমিষ আহার গ্রহণের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন ।রাজনারায়ণ বসু বাঙালির দুর্বলতা কাটাতে শরীরচর্চার পাশাপাশি সুষম খাদ্য গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছিলেন ।স্বয়ং বিবেকানন্দ মাংস খেয়ে শরীর গঠনের ওপর জোর দেয়েছিলেন।
অন্যদিকে রান্না এবং রান্নাঘরকে কেন্দ্র করে সেই সময়ে সাময়িক পত্রিকাগুলিতে বাঙালি গৃহবধূর অন্দরমহলে এবং পরিবারে অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা শুরু হয়েছিল। সুগৃহিনীর সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তাকে ভালো রাঁধুনি বা পাচিকা হতে হবে ।বাঙালি ভদ্রলোক উনিশ শতকে গৃহস্থজীবনে যে নতুন প্রতিরূপ ও বয়ান তৈরি করেছিল তার কেন্দ্রে ছিল নারী। বিশ শতকে এই নারীকে দেবী হিসেবে প্রতিপন্ন করে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে নেওয়া হয়েছিল ।