উনিশ শতকের বাংলা সংবাদপত্র ও সাহিত্য
উনিশ শতকে বাংলা সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র
সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উপাদান হিসেবে সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম।উনিশ শতকে ভারতে মূলত বাংলায় গণজাগরনের হাতিয়ার হিসেবে গণমাধ্যমের ভূমিকা ব্রজেন্দ্রনাথ বন্ধ্যোপাধ্যায় তার ‘স্ংবাদপত্রে সকালের কথা’ গ্রন্থে,বিনয় ঘোষ তার ‘সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র’ গ্রন্থে বিস্তৃত ভাবে তুলে ধরেছেন।সাম্প্রতিককালে আনিসুজ্জামান,মুনতাশির মামুন এবং স্বপন বসু প্রমুখ গবেষক বহুপরিশ্রম করে জরাজীর্ন সংবাদপত্র এবং সাময়িক পত্রগুলি সংকলিত করে উনিশ এবং বিশ শতকের বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন দিকগুলি তুলে ধরেছেন।
ভারতে সংবাদপত্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে জেমস অগাস্টাস হিকির হাত ধরে বেঙ্গল গেজেটের মাধ্যমে। হিকির সংবাদপত্রে শ্রেনীবদ্ধ বিজ্ঞাপণ ও টুকরো খবর প্রাধান্য পেত। ১৭৮০খ্রিঃ থেকে ১৮১৮ খ্রিঃ এর মধ্যবর্তী সময়ে প্রায় নয়দশটি পত্রিকা প্রকাশ পেয়েছিল। যেমন ইন্ডিয়া গেজেট(১৭৮০),বেঙ্গল জার্নাল(১৭৮৫ খ্রিঃ), দি ক্যালকাটা ক্রনিকল (১৭৮৬), ক্যালকাটা কুরিয়র (১৭৯৫),ইন্ডিয়া অ্যাপেলো (১৭৯৫),বেঙ্গল হরকরা(১৭৯৮) ইত্যাদি।তবে এই সংবাদপত্রগুলির সম্পাদনার দায়িত্ব এবং মালিকানা ছিল ইউরোপিয়ানদের হাতে।
ইতিমধ্যে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার, মিশনারী উদ্যোগে বাংলা হরফের উদ্বভ, শ্রীরামপুরে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা বাংলাভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশের পথ প্রশস্ত করেছিল। জন মার্শম্যান ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ‘দিগ,দর্শন’ প্রকাশ করেন।পত্রিকাটি চলেছিল দুবছর দুমাস।।এরপর মার্শম্যান ‘সমাচার দর্পণ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্্যের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাঙ্গাল গেজেট’।
মিশনারী উদ্যোগের বিপ্রতীপে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় প্রকাশ করেন ‘ব্রাহ্মন সেবধি’পত্রিকা এবং কিছুটা পরে ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকা।এই পত্রিকায় রামমোহন সহমর প্রথার বিরুদ্ধে ও অন্য সামাজিক আন্দোলনের স্বপক্ষে লেখা হতো।এর বিরোধিতা করে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ করলেন ‘সমাচার চন্দ্রিকা’।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে কবি ঈশ্বর গুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সংবাদ প্রভাকর’। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে এটি বাংলার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্রে পরিনত হয়।এই সময়কালে অন্যতম গুরুত্বপূর্ন পত্রিকা ছিল ‘স্ংবাদ ভাস্কর’ এবং ‘ বেঙ্গল স্পেক্টেটর’।উদারপন্থী মানসিকতার জন্য এই পত্রিকা দুটি সুনাম কুড়িয়েছিল। ‘ বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ ছিল ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর মুখপত্র,এছাড়া ছিল ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকা।
উনিশ শতকে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মানুষের শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছিল ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ এটি আদতে ছিল ধর্মভিত্তিক সাময়িক পত্র, কিন্তু অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় এই পত্রিকা ধর্মীয় গন্ডী অতিক্রম করে পূর্নাঙ্গ পত্রিকা হয়ে উঠেছিল। বাংলার প্রথম সচিত্র পত্রিকা হিসেবে ‘বিবিধার্থ-সংগ্রহ’ বলা যায়। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘সোমপ্রকাশ’ সম্পাদক ছিলেন দ্বারোকানাথ বিদ্যাভূষণ।
আঞ্চলিক এবং গ্রামীণ সাময়িকপত্র এবং সংবাদপত্রের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা। এই পত্রিকার কর্ণধার এবং সম্পাদক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার, যিনি কাঙাল হরিনাথ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন।১৮৬৩ খ্রিঃ তিনি নিজের পত্রিকা গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রকাশ করেন।মূলত গ্রাম এবং গ্রামবাসীদের অবস্থা প্রকাশের জন্য এর নাম হয় গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা।তবে মূল লক্ষ্য ছিল কৃষকদের ওপর নীলকর সাহেব ও জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশ করা।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মেয়েদের জন্য অনেক সাময়িক পত্রিকা হয়েছিল যেমন- ‘অবলাবান্ধব পত্রিকা’, ‘বঙ্গমহিলা’, ‘ বিনোদিনী’, ‘হিন্দুললনা’ ইত্যাদি।তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্নছিল ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’।বামাবোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল বামাবোধিনী সভার উদ্যোগে।বামাবোধিনী সভা কেশবচন্দ্র সেন এবং ব্রাহ্ম আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে বা ১২৭০ বঙ্গাব্দে ভাদ্রমাসে কলকাতার ১৬ নং রঘুনাথ চ্যাটুয্য স্ট্রীটের বাড়ির বামাবোধিনী সভার কার্যালয় থেকে বামাবোধিনী পত্রিকা প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল। বামাবোধিনী পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা উমেশচন্দ্র দত্ত। বামাবোধিনী পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হতো।থাকত ভ্রমণ বৃত্তান্ত,গল্প,উপন্যাস,কবিতা,চিত্রকলা,বিজ্ঞান, বিশ্লেষণ,বিদেশী নারী সাফল্য কাহিনী,শিক্ষা প্রসঙ্গ,স্বাস্থ্য জ্ঞান,শিশুপালন পদ্ধতি,ধর্ম আলোচনা এবং গার্হস্থ্য প্রসঙ্গ।তবে প্রধান বিষয়বস্তু ছিল তিনটি শিক্ষার প্রয়োজন ও সার্থকতা,শিশুপালন সংক্রান্ত নিয়মাবলী এবং পরিবারে রমণীর কর্তব্য ও স্থান।
‘বঙ্গদর্শন’ কে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পত্রিকা বলা যায়। বঙ্কিম চন্দ্রের সম্পাদনায় ১২৭৯ বঙ্গাব্দে ১লা বৈশাখ ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশিত হয়েছিল।বঙ্কিমের সম্পাদনায় এই পত্রিকা প্রায় চার বছর চলেছিল।
Last updated