ইন্দিরাকে লেখা জহরলাল নেহেরুর চিঠিপত্র
Last updated
Last updated
সরকারী চিঠিপত্রের পাশাপাশি ইতিহাস চর্চায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকাতে প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ চিঠি লেখা হয়েছিল। এগুলি বেশিরভাগ যুদ্ধরত সৈনিক ও তার পরিবারের মধ্যে লেখা। ঐ চিঠিগুলিতে ধরা পড়ে সমকালীন সমাজের ইচ্ছে-অনিচ্ছা,চাওয়া পাওয়া ।আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যোগদানকারী ভারতীয় সৈনিকদের চিঠি থেকে পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় সৈনিকদের অসহায়তা ও যন্ত্রণা এমনকি প্রতিবাদের কথা জানতে পারি ।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চা ও ব্যক্তিগত চিঠিপত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ । মনে রাখতে হবে তখন ব্যক্তিগত যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল চিঠিপত্র । ভারতীয় নেতৃবৃন্দ পরস্পরকে যে চিঠিপত্র লিখেছিলেন যেখানে সমসাময়িক ঘটনা, রাজনীতির কথা যেমন পাই তেমনি বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণ এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণ এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই ।
এ প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু, বল্লভ ভাই প্যাটেল,মহাত্মা গান্ধী এর চিঠিপত্রের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে ।
এই ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের ক্ষেত্রী অনন্য নজির হলো কন্যা ইন্দিরাকে লেখা পিতা জহরলাল নেহেরুর চিঠির সংকলন ।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে জহরলাল নেহেরু যখন জাতীয় রাজনীতিতে ব্যস্ত । অধিকাংশ সময়ে তিনি এলাহাবাদে থাকতেন । তখন তার একমাত্র কন্যা দশ বছরের ইন্দিরা তার নিঃসঙ্গ শৈশব কাটাচ্ছিল ।চিঠির মাধ্যমে মেয়েকে কিছুটা সহচর্য ও সঙ্গ দেওয়ার জন্য পাশাপাশি জীবজগৎ ও মানুষ সম্বন্ধে নিজের উপলব্ধিকে মেয়ের কাছে তুলে ধরার জন্য তিনি প্রথম পর্যায়ে বেশ কিছু চিঠি লেখেন ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য জহরলাল নেহেরু কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু চিঠিগুলির বৈশিষ্ট্য দেখে নেহেরুকে চিঠিগুলিকে বৃহত্তর পাঠকের সামনে তুলে ধরার পরামর্শ দেন ।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৩১টি চিঠি সংকলিত করে ১১৯ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন “Letters from a father to his daughter” শিরোনামে ।
বিখ্যাত হিন্দি ঔপন্যাসিক মুন্সি প্রেমচাঁদ এই বই হিন্দিতে অনুবাদ করেন ‘পিতা কে পত্র পুত্রীকে নাম’। ‘কল্যানীয়াসু ইন্দু’ শিরোনামে বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ।
জহরলাল নেহেরু তার বই এর ভূমিকায় লেখেন “আশাকরি তাদের মধ্যে যারা এগুলি পড়বে তারা আস্তে আস্তে আমাদের এই পৃথিবীকে বিভিন্ন জাতি দিয়ে তৈরি একটি বৃহৎ পরিবার হিসেবে ভাবতে শুরু করবে এবং কিছু সংশয় থাকলেও এও আশা করি যে চিঠিগুলি লেখার সময় যে আনন্দ পেয়েছি এগুলি পড়ে তারাও কিছুটা আনন্দ পাবে” ।
এখন প্রশ্ন হলো যে এই চিঠিগুলির বিষয়বস্তু কী?- এ প্রসঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে এই বইতে মুখবন্ধে লিখেছেন “পৃথিবীর প্রথম যুগের কথা এবং কীভাবে মানুষ নিজের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠল সে কথা এই চিঠিতে বলা হয়েছে । এ চিঠিগুলি শুধু একবার পড়েই ফেলে দেবার মতো নয় , এগুলি পড়ে আমি নতুন চোখে সব কিছু দেখতে শিখি । এগুলি মানুষের সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা করতে এবং চারপাশের জগত সম্বন্ধে আমার মনে আগ্রহ আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিল ।এসব চিঠি পড়েই প্রকৃতিকে একটি বই হিসেবে দেখতে শিখেছি ।ঘণ্টার পর ঘণ্টা তন্ময় হয়ে পাথর, গাছপালা,পোকা-মাকড়দের জীবন এবং রাত্রে আকাশের নক্ষত্র লক্ষ্য করে দেখেছি ” ।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট এই তিন বছরের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন কারাগারে ‘Glimpses of World history’ লিখিত হয়েছিল ।যদিও এই কারাজীবনের নেহেরুর কাছে ছিল ‘অবকাশ ও নির্লিপ্তর সুযোগ গ্রহণ’। এই দীর্ঘ সময় তিনি কারাগারে ছিলেন, তাই একমাত্র কন্যার শিক্ষার তত্ত্বাবধান করার সুযোগ ছিল না ।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে দুই বৎসরের জন্য কারারুদ্ধ হবার আগে তিনি তার চিঠিগুলি একত্রিত করেন এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে দুই বৎসরের জন্য কারারুদ্ধ হবার আগে তিনি চিঠিগুলি একত্রিত করেন এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে নেহেরুর ভগ্নী শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত এই পত্রগুলিকে একত্রিত করে ‘Glimpses of World history’ নামে প্রকাশ করেন ।
যদিও এরপর নেহেরু ভারতীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তন নেহেরুর অন্ত-লোককে আলোড়িত করেছিল। শুধু তাই নয় ইউরোপ ভ্রমণ কালে তার পাশ্চাত্যর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছিলেন । চীন ও স্পেনের সংগ্রামের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন। ফলত ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নতুন সংস্করণে নতুন আকারে এবং নতুন রূপে প্রকাশ পেয়েছিল ।
মাথায় রাখতে হবে যে নেহেরু এই গ্রন্থ বা চিঠি গুলি লিখেছিলেন কারাগারের বসে কিন্তু কারাগারে বইপত্রের বড়ই অভাব ।নেহেরুর একটি সুঅভ্যাস ছিল যখনই কোন ভালো বই পরতেন তিনি সেই বই এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ লিখে রাখতেন বা বইটির ওপর সংক্ষিপ্ত টীকা লিখে রাখতেন এই সংগ্রহ এই গ্রন্থ রচনায় যথেষ্ট সাহায্য করেছিল ।তবে যে বই তাকে খুব সাহায্য করেছিল তা হলো এইচ-জি-ওয়েলস এর ‘Outline of History’.
নেহেরু তার এই গ্রন্থের প্রস্তাবনাতে স্বীকার করেছেন-“ ইতিহাসের বর্ণনা যেরূপ নির্লিপ্ত ও নৈর্ব্যক্তিক হওয়া উচিত, এই পত্রের বর্ণনা সেরূপ হয় নাই ।আমি ইতিহাসকার নহি, ইতিহাস লিখি নাই ।এই পত্রাবলীর মধ্যে বহু স্থলে অপরিণত শিশুর নিকটে বলা সহজ আলোচনা এবং পরিণতবুদ্ধি ব্যক্তির যোগ্য গুরু গম্ভীর আলোচনার অসম মিশ্রণ ঘটিয়াছে,বহু স্থলে একটি কথার পুনরাবৃত্তি হইয়াছে ।
আমলে জহরলাল নেহেরু এই চিঠিগুলির মাধ্যমে শিশুকন্যা ইন্দিরার ইতিহাস চেতনা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । পণ্ডিত নেহেরুর ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ এই সবকিছুর নিদর্শন আছে তার চিঠিপত্রগুলিতে । জগত এবং শ্রমজীবী মানুষের প্রতি অনুভূতিপ্রবণ মনের প্রকাশ ঘটেছে এই লেখায় ।আমরা একটা উদাহরণ দিতে পারি , নেহেরু তার কন্যাকে লিখেছেন –“ তুমি মাঝ-দুপুরে গনগনে রোদে ভারতীয় চাষিকে কাজ করতে দেখেছো । গায়ে অনেক কাপড়-চোপড় দেবার পক্ষে নিতান্তই যে গরিব । তাই তার সারা শরীর রোদে স্নান করতে থাকে । এইভাবেই তার জীবন বয়ে চলে, সে তো কালো রঙের হতে বাধ্য । তাই আমরা দেখলাম মানুষের গায়ের রঙ পরিবেশের উপর নির্ভরশীল । এর সাথে ব্যক্তিগত গুনাগুণ কোনো সম্বন্ধ নেই ।