নতুন সামাজিক ইতিহাস

নতুন সামাজিক ইতিহাস

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান চর্চায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত হয়েছিল । আসলে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর সময়ে বেশ কিছু ঘটনা এই দৃষ্টিভঙ্গির ও মানসিকতার বদল করেছিল ।

প্রেক্ষাপট

পূর্ব ইউরোপে রুশ আগ্রাসন, তৃতীয় বিশ্বের মুক্তি সংগ্রাম,ভিয়েতনাম ও কিউবায় আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ ,ফ্রান্স ও ইউরোপে ছাত্র আন্দোলন, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন তরুণ সম্প্রদায় ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মন ও মননকে আন্দোলিত করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিকতা, রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে ভাষ্য উপস্থাপিত করেছিল । ফলত জ্ঞানচর্চার প্রচলিত কাঠামো ও বয়ানের বিপ্রতীপে নতুন তত্ত্ব এবং চিন্তার উন্মেষ হয়েছিল,ইতিহাসের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নি।

সূত্রপাত

ইংল্যান্ডে ‘পাস্ট এন্ড পেজেন্ট’ পত্রিকা এবং ফ্রান্সের অ্যানাল পত্রিকার মাধ্যমে নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত হয়েছিল। যদিও ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জর্জ মেকলে ট্রেভেলিয়ন তার ‘দ্য ইংলিশ সোশ্যাল হিস্ট্রি’ গ্রন্থে মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও রীতিনীতিকে তুলে ধরেছিলেন। অন্যদিকে ই.পি. থমসন তার বিখ্যাত ‘মেকিং অব ইংলিশ ওয়াকিং ক্লাস’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন কীভাবে কৃষি ও শিল্পে মূলধনেরন প্রাধান্য সাধারণ সামাজিক,নৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করেছিল।আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চায় হারবার্ট গুটম্যান ও ইউজিন জেনোভিস শ্রমিক ও ক্রীতদাসদের জীবন ও জীবনযাপনের ওপর আলোকপাতকরেছেন।

তবে নতুন সামাজিক ইতিহাস রচনার প্রকৃত সূত্রপাত হয়েছিল লুসিয়েন ফেঁভর, ফার্নান্দ ব্রদেল,রয় লাদুরি, এবং মার্ক ব্লখের হাত ধরে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মার্ক ব্লখ ও লুসিয়েন ফেবর অ্যানাল্‌স অব ইকনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল হিস্ট্রি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত । ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে ‘সোশ্যাল সায়েন্স হিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েসন্স’।

নতুন সামাজিক ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য

১। ইতিহাস চর্চায় দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্ব পেয়ে এসেছিল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বা ‘বড়ো মানুষ’ এর কথা। বিষয়বস্তু হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে মূলত রাজনৈতিক ইতিহাস এবং ইতিহাস চর্চার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মূলত ‘টপ ডাউন’ পদ্ধতি বা উঁচুতলা থেকে ইতিহাস। কিন্তু নতুন সামাজিক ইতিহাসে গুরুত্ব পেল সাধারণ মানুষ। সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক, টানাপোড়েন ও ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া।শুধু তাই নয় সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত নানা সামাজিক উপাদান যেমন খাদ্য,পোশাক-পরিচ্ছদ,খেলাধুলা, বিনোদন, শিল্পচর্চা ইত্যাদি গুরুত্ব পেল। এই পদ্ধতি হলো ‘বটম আপ’ পদ্ধতি।

২। নতুন সামাজিক ইতিহাসের মূল উপজীব্য বিষয় হলো- সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস।সাধারণ মানুষের স্থানীয়, পৌর ও সামাজিক জীবন,সংস্কৃতি,জনস্বাস্থ্য,দারিদ্র,দুর্ভিক্ষ,হিংসা এবং দাঙ্গা অন্যতম বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।

৩। নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চায় ইতিহাসের প্রচলিত উপাদান যেমন- ব্যক্তিগত ডায়রি,হিসাব খাতা।পারিবারিক অ্যালবাম,কথকতা,বিভিন্ন লিফলেট,অনুপত্রিকা গুরুত্ব পেয়েছে।সবচেয়ে বড়ো কথা লিখিত উপাদানের পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সাক্ষাৎকার বা মৌখিক ঐতিহ্য।

৪। নতুন সামাজিক ইতিহাসে সমাজের প্রান্তিক মানুষদের জীবন এবং জীবনসংগ্রাম গুরুত্ব পেয়েছে । অসংগঠিত শ্রমিক,ভূমিহীন কৃষক, আদিবাসী মানুষের ইতিহাসের উপজীব্য হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি মেয়েদের ইতিহাস মেয়েদের লেখায় ও ভাষায় ফুটে উঠেছে।নতুন ইতিহাস চর্চায় যাকে বলে ‘ Gender Study’ ।

৫। নতুন সামাজিক ইতিহাস মূলত ‘multilayered’ এবং এর দৃষ্টিভঙ্গি হলো ‘interdisciplinary’ অর্থাৎ ইতিহাসের সঙ্গে নৃতত্ত্ব,ভূগোল,মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এমনকি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ।

৬। অন্যদিকে সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চায় ‘micro level’ গবেষণা গুরুত্ব পেয়েছে ।‘Global History’ এর তুলনায় ‘Local History’ হাসসমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা যথেষ্ট মান্যতা পেয়েছে।

এবার কয়েকটা উদাহরণ সহকারে ব্যাপারটা বুঝে নেবার চেষ্টা করবো।

জর্জ ডুবি,লাদুরি ফ্রান্সের কৃষক শ্রেণির ওপর গবেষণা করতে গিয়ে অর্থনীতির পাশাপাশি প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত তত্ত্ব,শস্যের ফলনের হিসেব,মহামারি ইত্যাদির দিকে আলোকপাত করলেন। মার্ক ব্লখ তার সাড়া জাগানো ‘Feudal Society’ বইতে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ,রাজনীতি, প্রযুক্তি ও মনস্তত্ত্বকে গুরুত্ব দিয়ে বিচারক করেছিলেন । অ্যানাল স্কুলের অন্যতম ঐতিহাসিক ব্রদেল ইতিহাসের সময়কে ‘Geographical Time’, ‘Social Time’, ‘Individual Time’ এই তিনভাগে ভাগ করে বিশ্লেষণ করেছেন। ব্রদেলের বিখ্যাত ‘ The Mediterranean’ গ্রন্থ আদতে ‘Geo History’।

ভারতে নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চায় সূত্র ধরে বিখ্যাত ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহর হাত ধরে নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত হয়েছিল সত্তরের দশকে।

নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চা বিষয়ক কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ও তার রচয়িতার নাম।

নতুন সামাজিক ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য (সংক্ষিপ্ত রূপ)

  • নীচুতলা থেকে ইতিহাস ।

  • অপ্রচলিত উপাদানের গুরুত্ব ।

  • প্রান্তিক মানুষের জীবন সংগ্রাম ।

  • বহু-স্তরীয় এবং আন্তঃ-বিদ্যা বিষয়ক ।

  • স্থানীয় ইতিহাস।

Last updated