বর্তমান ভারত ।

প্রক্ষাপটঃ

পাশ্চাত্য দেশ ভ্রমণ করে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফেরার পর বিবেকানন্দ ভারতের বহু রাজ্য পরিভ্রমণ করেন । ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা পত্রিকা উদ্বোধনের প্রকাশ শুরু করেন ।এই পত্রিকার জন্য একে একে ‘ভারত কথা’,‘পরিব্রাজক’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ এবং অবশ্যই ‘বর্তমান ভারত’ লিখতে শুরু করেন ।

প্রকাশ:

বর্তমান ভারত প্রথমে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে থেকে উদ্বোধন পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, পরে স্বামী শুদ্ধানন্দের উদ্যোগে স্বামী সারদানন্দের ভূমিকা সংবলিত হয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ।

বিষয়বস্তু:

বর্তমান ভারত গ্রন্থে বিবেকানন্দ সমসাময়িক ভারতকে বিশ্লেষণ করেছেন দশ হাজার বছর পুরনো ভারতের ইতিহাসের নিরিখে।

পৃথিবীর সর্বত্র ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্র চারটি বর্ণ পর্যায়ক্রমে পৃথিবী শাসন করবে।প্রথম দুটি বর্ণের শাসনকাল শেষ হয়ে গেছে।তৃতীয় বর্ণ বৈশ্যের শাসনকাল সমাপ্তির মুখে। চতুর্থ বর্ণ শূদ্রের জাগরণ অবশ্যম্ভাবী।

পুরোহিতের শাসন:

উর্বর মস্তিষ্ক ও জ্ঞানে বলীয়ান হয়ে পুরোহিতরা রাজশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করত। রাজারাও পুরোহিতদের খুশি করতেন। বৈশ্য ও সাধারণ প্রজার বিশেষ গুরুত্ব ছিল না ।

ক্ষত্রিয় শাসন:

বৌদ্ধযুগ থেকে মুঘল যুগ পর্যন্ত ক্ষত্রিয় শাসন চলেছিল।বৌদ্ধ ও জৈন যুগে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য,রাজর্ষি অশোক প্রমুখ রাজার উত্থানে ক্ষত্রিয় শক্তির কাছে ব্রাহ্মণ শক্তি পরাভূত হয়।

এরপর এসেছিল মুসলিম যুগ। মুসলিম রাজত্বে রাজাই পুরোহিতের স্থান গ্রহণ করলো।

বৈশ্য শাসন:

ভারতে মুঘল রাজশক্তিকে পরাভূত করে ইংরেজ শক্তি ভারতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে বৈশ্যশক্তি হিসেবে বাণিজ্যই তাদের মূল শক্তি ছিল ।

শূদ্র জাগরণ:

শূদ্ররা ‘ভারবাহী পশু’ হিসেবে বিবেচিত হলেও পৃথিবীর অন্যত্র শূদ্ররা জেগে উঠেছে।ভারতেও শূদ্রদের অবস্থার পরিবর্তন হবে ।বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন’এর পরেই পৃথিবীতে শূদ্র যুগ আসছে’।

বর্তমান ভারত গ্রন্থে প্রভাব:

বর্তমান ভারত গ্রন্থে স্বামীজী মানুষ,সমাজ ও দেশকে একই সূত্রে বেঁধে কর্মসাধনার মাধ্যমে আধুনিক ভারত নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে ভারতের মুক্তি হবে না তাই তিনি গ্রন্থে বলেছেন “হে ভারত,এই পরানুবাদ,পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা,এই দাস সুলভ দুর্বলতা এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা-এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে?......।এই লজ্জাকর কাপুরুষতা সহায়ে তুমি বীরভোগ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে”।

বিবেকানন্দ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ভারতের ঐক্যের কথা বলেছেন ভারতের সংহতির কথা বলেছেন । তিনি আহ্বান জানান-

“ হে ভারত ভুলিও না ... তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত...।।ভুলিও না নীচ জাতি-মূর্খ,দরিদ্র,অজ্ঞ,মুচি,মেথর, তোমার রক্ত তোমার ভাই।হে বীর সাহস অবলম্বন কর ।সদর্পে বল আমি ভারতবাসী,ভারতবাসী আমার ভাই।......বল ভাই- ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ,ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ......”।

স্বামীজী বিশ্বাস করতেন অসংখ্য অসহায়,আর্ত দরিদ্র মানুষকে অবহেলা করে শক্তিশালী স্বাধীন ভারত গড়ে উঠতে পারে না ।তাই তিনি বলেছেন

“দরিদ্র নারায়ণ সেবার মহৎ আদর্শ ঘিরেই সব ধর্মীয় সম্প্রদায়,বর্ণ,জাতি ও শ্রেণি অনায়াস মিলন ছিল সম্ভবপর। ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন,অসুস্থের সেবা এবং অজ্ঞকে জ্ঞানদানের মধ্য দিয়ে মানুষের স্বার্থপরতার অবসান ঘটে”।

এই পুস্তিকার শেষ অনুচ্ছেদে ভারতবাসীর কী করা উচিত সে ব্যপারে বিবেকানন্দ সরাসরি বলেন ‘ভারত যতদিন ইংরেজ শাসনের দাস সুলভ দুর্বলতা সম্বল করে চলবে ততদিন জগৎ সভায় ‘ উচ্চাধিকার’ লাভ করবে না ।

মূল্যায়ণঃ

বর্তমান ভারত গ্রন্থের মুখবন্ধে স্বামী সারদানন্দ বলেছেন “স্বামী বিবেকানন্দের সর্বতোমুখী প্রতিভা প্রসূত ‘বর্তমান ভারত’ বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ”।

অরবিন্দ ঘোষ বলেছেন “বিবেকানন্দ আমাদের জাতীয় জীবনের গঠনকর্তা”

বিপিনচন্দ্র পাল বিবেকানন্দকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত’ বলে উল্লেখ করেছেন।

ভিডিও লেকচার দেখার জন্য নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন ।

Last updated