বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ।
Last updated
Last updated
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বা স্বদেশী আন্দোলনে বাংলার কৃষক শ্রেণি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও শ্রমিক ও কারিগরেরা সংগঠিত ও অসংগঠিত ভাবে আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। তাদের নিজস্ব দাবি-দাওয়াগুলির সঙ্গে জাতীয় আন্দোলনের ভাবাবেগকে সংযুক্ত করেছিল ।
শ্রমিকদের অংশগ্রহণের কতগুলি কারণ ছিল:-
১) দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি এবং জাতিগত অপমানের বিরুদ্ধে সংগঠিত ধর্মঘটগুলি স্বদেশিনেতা ও জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলির সমর্থন পেতে শুরু করেছিল ।
২) বহু স্বদেশী নেতা স্থায়ী ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলে,ধর্মঘটে শ্রমিকদের আইনি সাহায্য দেওয়া,ধর্মঘট তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা ইত্যাদি কাজে উদ্যোগ নিয়েছিল ।
৩) শ্রমিকরা তাদের আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ও মালিক পক্ষের ওপর চাপ তৈরি করে কাজের সময়সীমা হ্রাস,মজুরি বৃদ্ধি,অতিরিক্ত কাজের জন্য মজুরি আদায় ইত্যাদি দাবীগুলি আদায় করতে চেয়েছিল ।
৪) কলকাতা ও মফঃস্বলে স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে ভাবাবেগ তৈরি হয়েছিল মিটিং,মিছিল,পিকেটিং,সভা সমিতি,বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণ তা শ্রমিকদের মনকে আন্দোলন মুখর করে তুলেছিল ।
শ্রমিক আন্দোলনে জন সমর্থন জুগিয়ে ছিলেন বিপিন চন্দ্র পাল,চিত্তরঞ্জন দাশ,লিয়াকত হোসেন এর মতো জাতীয়তাবাদী নেতারা । তবে যে চার জন নেতা শ্রমিক আন্দোলনের কাণ্ডারি ছিলেন এই পর্বে তারা ছিলেন অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,প্রভাত কুমার রায় চৌধুরী,অপূর্ব কুমার ঘোষ এবং প্রেমতোষ বসু ।প্রথম তিনজন ছিলেন ব্যারিস্টার আর প্রেমতোষ বসু ছিলেন উত্তর কলকাতার একটি ছাপাখানার মালিক । মূলত সরকারি ছাপাখানা, রেল, চটকল, এবং ট্রাম শ্রমিকদের মধ্যে ঐ চার নেতার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে ।
বিভিন্ন ধর্মঘটের ও আন্দোলনের নিদর্শন:-
১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর যেদিন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় সেদিন নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে শ্রমিকরাও প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল ।সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ঐ দিন প্রায় সব দপ্তরে তালা ঝুলেছে ,রাস্তায় গাড়োয়ান ছিল না । আর কয়েকটি চটকল ও রেল কর্মশালায় ধর্মঘট পালিত হয় ।
হাওড়ার বার্ণ কোম্পানির ২৪৭জন কেরানি প্রতিবাদে কাজ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন । অনেকের মতে এটি ছিল স্বদেশী যুগে বাংলায় প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট ।
ছাপাখানা কর্মীদের আন্দোলন:- কলকাতায় সরকারি ছাপাখানায় কর্মীরা ধর্মঘট শুর করে ,বি.জি.প্রেস,আই.জি.প্রেসে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ।ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ও শ্যামসুন্দর বসু ধর্মঘটী দের পাশে দাঁড়ান । এই দুই নেতার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় সম্ভবত বাংলার প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন ‘প্রিন্টস অ্যান্ড কম্পোজিটর লীগ’।‘বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট প্রেস’এর কর্মীরা এই ধর্মঘটকে সমর্থন করেছিল ।
কুলিও মেথর ধর্মঘট:- কলকাতা পৌরসভার প্রায় ২০০০কুলি ও মেথর ধর্মঘট করেন ।সুমিত সরকার তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এই সব শ্রমিক ধর্মঘটের সমর্থনে কলকাতার রাস্তায় মানুষের মিছিল বেরিয়েছিল । ধর্মঘটীদের মিছিলে মানুষ চাঁদা দিয়েছিল সরবরাহ করেছিল খাদ্য ।
রেল ও ট্রাম শ্রমিকদের ধর্মঘট:- ১৯০৬খ্রিস্টাব্দে রেলওয়ে শ্রমজীবীরা আন্দোলন পরিচালনার জন্য ‘রেলওয়ে মেনস ইউনিয়ন’গঠন করে । চিত্তরঞ্জন দাশ,বিপিনচন্দ্র পাল,লিয়াকৎ হোসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ধর্মঘটীদের পাশে দাঁড়ান । ক্রমে এই আন্দোলন জামালপুর,আসানসোল,খড়গপুর,প্রভৃতি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে । ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের প্রায় ৯৫০ জন গার্ড বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করে । ১৯০৬খ্রিঃ ২৭শে আগস্ট রেলের জামালপুর ওয়ার্কশপের শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন । পুলিশ গুলি চালায়,রাষ্ট্রীয় দমননীতির পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট ভেঙে যায় ।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে ট্রাম শ্রমিকরা ধর্মঘট করে । অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও অপূর্ব কুমার ঘোষের প্রচেষ্টায় তার নিষ্পত্তি হয় ।
চটকল ও মিল শ্রমিকদের আন্দোলন:- বাংলায় ৩৭টা চটকলের মধ্যে কমবেশি আঠারোটি চটকল শ্রমিক ধর্মঘট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল-
হাওড়ায় বাউরিয়া ফোর্ট গ্লাস্টার মিলটিতে ধর্মঘট শুরু হয় এখানে শ্রমিকরা রাখিবন্ধন উৎসব পালন করে ।
বজবজের ক্লাইভ জুটমিলের শ্রমিকেরা বেতন বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন শুরু করেছিল ।
অশ্বিনী কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে চটকল শ্রমিকদের নিয়ে বজবজে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান মিল হ্যান্ডস ইউনিয়ন’।
বন্দরের ধর্মঘট:-কলকাতা বন্দরের জেটিতে নিযুক্ত ৪০০জন বিভাগীয় শ্রমিক এ.সি.ব্যানার্জী ও প্রেমতোষ বোসের নেতৃত্বে ধর্মঘট শুরুকরে । ১৯০৭খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে কলকাতা ও খিদিরপুরে ডকে ২০০শ্রমিক ধর্মঘট করে ।
কলকাতার বাইরে শ্রমিক আন্দোলন:- ১৯০৭খ্রিস্টাব্দে রাওয়ালপিন্ডিতে অস্ত্র ও রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানাতে শ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করে ।
পাঞ্জাব থেকে বহিষ্কার করা হয় অজিত সিং ও লালা লাজপত রায় কে।
তামিলনাড়ু তুতিকোরিনে বিদেশী মালিকাধীন একটি বস্ত্র কারখানায় ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচার করেন সুব্রক্ষন্যম শিব ও চিদাম্বরম পিল্লাই । এই দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলে তুতিকোরিন ও তিরুনেলাভিলিতে ব্যাপক ধর্মঘট ও সংঘর্ষ শুরু হয়।
মহারাষ্ট্রে’মারাঠা’ ও ‘কেশরী’ পত্রিকায় সরকারের তীব্র সমালোচনা করায়-তিলককে গ্রেপ্তার করা হয় বিচারে তার ৬বছরের কারাদণ্ড হলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ ।বম্বের বস্ত্র কারখানা ও রেল ওয়ার্কশপে শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট করেন । প্রায় ৬দিন তাদের ধর্মঘট চলে । শ্রমিকদের বলপূর্বক কাজে যোগদিতে বাধ্যকরে পুলিশ ।শ্রমিকদের দমন করার জন্য সামরিক বাহিনী নামানো হয় । পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর গুলিতে ১৬জন শ্রমিক নিহত হয়। লেলিন এই আন্দোলন কে অভিনন্দিত করে বলেন ‘রাজনৈতিক মঞ্চে ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে’ সুমিত সরকার এই ধর্মঘটকে প্রকৃত অর্থে ‘রাজনৈতিক ধর্মঘট’ আখ্যা দিয়েছে।