হিন্দুমেলা ।

উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নব্য হিন্দুবাদ এবং জাতীয় গৌরব বৃদ্ধির প্রবণতা সভা সমিতি গঠনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল ।

ডিরোজিও এর শিষ্যদের জনপ্রিয়তায় আশঙ্কিত হয়ে রাজনারায়ণ বসু মেদিনীপুরে থাকাকালীন ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী বা গৌরবেচ্ছা সঞ্চারণী সভা’ স্থাপন করেন । এরই সূত্রধরে হিন্দু মেলার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ।

হিন্দু মেলার প্রতিষ্ঠা –

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্থিক সাহায্যে ও নবগোপাল মিত্রের সম্পাদনায় “The National Paper ” সাপ্তাহিকটিতে “Prsopectus of society for the Promotion of National Fealing among the Educated Native of Bengla” নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন যা পুস্তিকা আকারে মুদ্রিত হয় ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়’।

১৮৬৭ খ্রিঃ মার্চ মাসে নবগোপাল মিত্রের ‘A National Gathering’ শীর্ষক আবেদনে আসন্ন চৈত্র সংক্রান্তির দিন একটি সম্মেলনের আয়োজনের কথা লেখা হয় । জাতীয় মেলার প্রথম অধিবেশন হয় ১৮৬৭খ্রিঃ ১২ই এপ্রিল ।

নব গোপাল মিত্রের ‘ন্যাশনাল পেপারে’ ১৭ই এপ্রিল ১৮৬৭ তারিখে মেলার প্রথম অধিবেশনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায় । অধিবেশন হয়েছিল চৈত্র সংক্রান্তির দিন চিৎপুরে রাজা নরসিংহ রায়ের বাগান বাড়িতে ।

মেলার প্রথম অধিবেশন হয়েছিল ১৮৬৭ খ্রিঃ চৈত্র সংক্রান্তিতে । প্রথম তিন বছর একে চৈত্র মেলা বলাহত । ১৮৭৬খ্রিঃ থেকে মেলার অধিবেশন মাঘ সংক্রান্তিতে হতো । তৃতীয় বৎসরের কার্যবিবরণে এই মেলার নাম হিন্দু মেলা বলে স্বীকৃত হলেও চতুর্থ বৎসর থেকে এটি হিন্দু মেলা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে ।

নেতৃত্ব:-

হিন্দু মেলার প্রাণ পুরুষ ছিলেন নবগোপাল মিত্র এবং বিশিষ্ট সহযোগী ছিলেন গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর । প্রথম দিকে হিন্দু মেলার সম্পাদক ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের মেজদাদা গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর । নবগোপাল মিত্র সহকারী সম্পাদক ছিলেন ।

হিন্দু মেলার উদ্যেশ্যঃ- -

হিন্দু মেলার কর্মকর্তাদের দুটি বক্তব্যে এই সভা স্থাপনের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা সম্ভব । দ্বিতীয় বৎসরের অধিবেশনে গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন “আমাদের এই মিলন সাধারণ ধর্ম-কর্মের জন্য নহে, কোনও বিষয় সুখের জন্যও নহে, কোনও আমোদ প্রমোদের জন্য নহে, ইহা স্বদেশের জন্য ইহা ভারত ভূমির জন্য ।

মেলার দ্বিতীয় বর্ষে মনোমোহন বসু প্রদত্ত বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়েছে “...কিন্তু এই চৈত্র মেলা নিরবচ্ছিন্ন স্বজাতীয় অনুষ্ঠান,ইহাতে ইউরোপীয়দিগের নাম গন্ধ মাত্র নাই এবং যে সকল দ্রব্য সামগ্রী প্রদর্শিত হইবে তাহাও স্বদেশীয় জনগণের হস্ত সম্ভূত স্বজাতির উন্নতি সাধন, ঐক্য স্থাপন এবং স্বাবলম্বন অভ্যাসের চেষ্টা করাই এই সমাবেশের একমাত্র পবিত্র উদ্দেশ্য”।

হিন্দু মেলার কার্যাবলীঃ- হিন্দু মেলার বাৎসরিক অধিবেশন গুলিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান সূচী লিপিবদ্ধ থাকতো । যেমন –

সাহিত্য,দর্শন, ধর্ম,বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ পাঠ ।

কুস্তি,অশ্বচালনা,পাইক খেলা,বাঁশবাজি প্রভৃতি প্রদর্শন ।

দেশের নানা স্থান থেকে কামার,কুমোর, স্বর্ণকার,তন্তুকার,মৃৎ শিল্পী,চর্মশিল্পীদের শিল্পদ্রব্য প্রদর্শন ।

মেলায় ফুল, ও কৃষিজাত দ্রব্যের প্রদর্শন হত।

এছাড়া কুশলী শিল্পী ও বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা সম্মানিত হতেন এবং দেশাত্মবোধক কবিতা ও সঙ্গীত পরিবেশন করতেন ।

দ্বিতীয় বৎসরে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত মিলে সবে ভারত সন্তান/একতান মন প্রাণ, গাহ ভারতের যশোগান ’ পরিবেশন করাহয় । জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর নবগোপাল মিত্রের অনুরোধে জীবনের প্রথম কবিতা ‘জন্মভূমি জননী,স্বর্গের গরীয়সী।/জাগ জাগ ভারত সন্তান’ পাঠ করেন ।

১৮৭৫খ্রিষ্টাব্দে ১১ফেব্রুয়ারি পার্শি বাগানে অনুষ্ঠিত হিন্দু মেলার নবম অধিবেশনে চতুর্দশীয় বালক রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দু মেলার উপহার’ নামে বিখ্যাত কবিতা আবৃতি করেন । ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে মেলার একাদশ অনুষ্ঠানে তিনি দিল্লীর দরবারে নামে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন ।

বিপিন চন্দ্র পাল তার ‘হিন্দু মেলা ও নবগোপাল মিত্র’ প্রবন্ধে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষার কথা উল্লেখ করেছেন । তিনি লিখেছেন তখনও ও অস্ত্র আইন লিপিবদ্ধ হয় নাই ।সুতরাং বন্দুক ছোঁড়া বা তরোয়াল খেলা অভ্যাস করা কঠিন ছিলনা ।ধাপার মাঠে যাইয়া হিন্দু মেলার বিশিষ্ঠ কর্মকর্তারা পাখী শিকারের ভান করিয়া বন্ধুক ছোঁড়া অভ্যাস করিবার চেষ্টা করিতেন” ।

হিন্দু মেলার গুরুত্ব –

হিন্দু মেলার চতুর্থ অধিবেশনের পর নবগোপাল মিত্র ‘ন্যাশনাল সোসাইটি’বা ‘জাতীয় সভা’প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় সভার মাসিক অধিবেশনগুলিতে দেশবাসীর হিতসাধন মূলক শিক্ষা ,সাহিত্য,বিজ্ঞান,বাণিজ্য, কৃষি,সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক আলোচনার ব্যবস্থা হতো ।

হিন্দু মেলার সদস্যদের হিন্দু হতেই হতো কিন্তু এই মেলাতে নানা আদর্শের মেল বন্ধন ঘটেছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির দিজেন্দ্রনাথ-সত্যেন্দ্রনাথ,গনেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এমনকি রবীন্দ্রনাথ যোগদান করেন ।অন্যদিকে রাজনারায়ণ বসু, মনোমোহন বসু ও নবগোপাল মিত্রের মতো আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতারা এই মেলায় যোগদান করেছিলেন ।

হিন্দু মেলার অবসান –

১৮৮০খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ অধিবেশন সম্ভবত হিন্দু মেলার শেষ অধিবেশন ।হিন্দু মেলার অবনতির একটি অন্যতম কারণ এএই সময়ে একাধিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল ।ইন্ডিয়া লীগের জন্ম হয়েছিল ১৮৭৫ সালে এবং ১৮৭৬ খ্রিষ্ঠাব্দে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাহয় ।এই সব প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক উদ্দীপনার যে নতুন স্বাদ শিক্ষিত সম্প্রদায় পেয়েছিলেন হিন্দু মেলায় তার অভাব ছিল।

হিন্দুমেলার ওপর ভিডিও লেকচার দেখার জন্য নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন ।

Last updated