অসহযোগ আন্দোলন পর্বে নারীদের অংশগ্রহণ ।

অসহযোগ আন্দোলন পর্বে নারীদের অংশগ্রহণ ।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বা স্বদেশী আন্দোলন পর্বে নারীরা অন্তপুরের আঙ্গিনা অতিক্রম করে সমাজ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর প্রবেশ করেছিল। পিকেটিং বিদেশি দ্রব্য বর্জন মিটিং মিছিলের মাধ্যমে নারীরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল কিন্তু এই আন্দোলন ছিল স্থানিক এবং আঞ্চলিক।

সর্বভারতীয় স্তরে জাতীয় আন্দোলনে গান্ধীজি প্রদর্শিত পথে নারীর অংশগ্রহণ করেছিল অসহযোগ আন্দোলন পর্বে।

দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে গান্ধীজীর নারীর স্বার্থহীন আত্মত্যাগের কথা উপলব্ধি করেছিলেন। গান্ধীজী নারীশক্তিকে জাতির সেবার কাজে লাগাবার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতীয় কল্পকাহিনী পুরান থেকে সীতা, দ্রৌপদী, দময়ন্তীর মতো আদর্শ নারীদের তিনি সমসাময়িক সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে পুনঃনির্মাণ করেন। এইসব মহীয়সী নারীরা ছিলেন নীতিনিষ্ঠ, পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের মঙ্গলার্থে চূড়ান্ত স্বার্থত্যাগ করার মত নৈতিক ও মানসিক শক্তির অধিকারিণী ছিলেন । গান্ধীজী এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন সীতাকে। কারণ ব্রিটিশ রাজ কে সহজেই রাবনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তবে মুসলমান মহিলাদের ক্ষেত্রে গান্ধীজীর হিন্দু উপমা বা চরিত্রগুলি এড়িয়ে গিয়ে জোর দিয়েছিলেন ইসলামের আত্মত্যাগে।

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রাওলাট সত্যাগ্রহের সময় তিনি মহিলাদের জাতীয়তাবাদী অভিযানে অংশ নেবার আহ্বান জানান। যদিও ওই আন্দোলন ছিল সংক্ষিপ্ত। ইতিমধ্যে সরোজিনী নাইডু গঠন করেন ‘রাষ্ট্রীয় স্ত্রী সংঘ’।তিনি এই সংগঠনের সদস্যদের জেলাস্তরে কংগ্রেস কমিটিতে অংশগ্রহণের কথা বলেন।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন গান্ধীজি মহিলাদের এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। তবে তাদের ভূমিকাকে সীমিত করে দেন মূলত বিদেশি দ্রব্য বয়কট স্বদেশী সামগ্রীর প্রচার এবং বিক্রয় সীমিত রাখা হয় মহিলাদের অংশগ্রহণ।

কিন্তু নারীরা এই সময় আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে তার বেশ কিছু নিদর্শন দিচ্ছি।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ ও ইংল্যান্ডে যুবরাজ ভারতে পদার্পণ করলে প্রায় এক হাজার মহিলা বিক্ষোভ দেখান।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উদ্যোগে কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবকেরা খদ্দরের কাপড় বিক্রি শুরু করে রাস্তায় পুলিশ চিত্তরঞ্জন দাশ ও তার পুত্র এবং স্বেচ্ছাসেবক সহ অনেককে গ্রেফতার করে। এই অবস্থায় দেশবন্ধুর পত্নী বাসন্তী দেবী, ভগিনী উর্মিলা দেবী, ভাগ্নি সুনীতি দেবী, প্রকাশ্য রাস্তায় খাদি এবং খদ্দর বিক্রি করলে, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেন। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ায় চারিদিকে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বাংলার নারী সমাজ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত রাত্রে 11 টার সময় পুলিশ তাদের মুক্তি দেয়। গান্ধীজী ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় বাংলার এই দৃষ্টান্ত তুলে ধরে অন্য নারীদের তা অনুসরণের উপদেশ দেন। বাসন্তী দেবী ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।

দেশবন্ধুর ভগিনী উর্মিলা দেবী মহিলাদের মধ্যে স্বরাজের আদর্শকে প্রচার এবং চরকা ও খাদিবস্ত্রকে জনপ্রিয় করার জন্য ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নারী কর্ম মন্দির’। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন হেমপ্রভা মজুমদার।

অন্যদিকে মোহিনী দেবী অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাড়ি বাড়ি খদ্দর বিক্রি, সভা-সমিতিতে বক্তৃতাদান এবং মফ:স্বলে স্বরাজের বার্তা প্রচার করেন।

ঢাকার গেন্ডারিয়ায় আশালতা সেন ‘শিল্পাশ্রম’ নামে মেয়েদের জন্য বয়ন কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি ব্যবস্থা করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্থাপন করেন ‘গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি’।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের চাঁদপুরে কুলি নিগ্রহ এবং স্টিমার ধর্মঘটে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত পত্মী নেলি সেনগুপ্তা প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছিলেন।

মেদিনীপুরের কাঁথিতে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল এর নেতৃত্বে ইউনিয়নবোর্ড বিরোধী আন্দোলনে মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ভারতের প্রথম ছাত্রী সংগঠন ‘দিপালী সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

লতিকা ঘোষ এর নেতৃত্বে এবং সুভাষচন্দ্র বসুর মাতা প্রভাবতী বসু সভাপতিত্বে ‘মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ’ স্থাপিত হয়েছিল।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে একটি স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী ঘোষিত হয়েছিল।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ৬৪ দিন অনশনের পর কারাগারে যতীন দাস এর মৃত্যু হলে বাংলার নারীরা অরন্ধন পালন করেন।

অসহযোগ আন্দোলনকালে সিলেটের সরলাবালা দেবী, বালুরঘাটে প্রভা চট্টোপাধ্যায়, বরিশালে ইন্দুমতী গুহ ঠাকুরতা, নোয়াখালীর সুশীলা মিত্র, খুলনার স্নে্হশীলা চৌধুরী, বর্ধমানের সুরমা মুখোপাধ্যায়, সিরাজগঞ্জের বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী, বরিশালে প্রফুল্লকুমারী বসুর মতো নারী’রা অংশ নিয়েছিলেন।

সমাজের প্রতিতারাও অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। মানদা দেবীর” শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত” নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় তিনি এবং তাঁর অন্য সঙ্গীরা ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজি বরিশালে এলে প্রায় ৩০০ পতিতা সেই সভায় যোগদান করেন অনেকে তাদের পেশা পরিত্যাগ করে ‘কুটির শিল্পাশ্রমে'এ যোগদান করেছিলেন।

বাংলার বাইরে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ।।

ভোটাধিকার জন্য আন্দোলন : সরোজিনী নাইডু ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের অধিবেশনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভোটাধিকার নিয়ে সরব হন।ভারতের প্রথম মহিলা আইনসভার সদস্য মুথুলক্ষীর রেড্ডি মহিলাদের ভোটাধিকার নিয়ে সরব হন। তিনি প্রথম দেবদাসী প্রথার বিলোপ সাধনের জন্য বিল এনেছিলেন।

মহম্মদ আলী এবং শওকত আলীর মাতা বাঈ আম্মান এর বক্তব্য শোনার জন্য আমেদাবাদে সারা ভারত মহিলা সম্মেলনে ৬০০০ মহিলা উপস্থিত ছিলেন। বাঈ আম্মা নারীদের কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণের কথা বলেন।

মাদ্রাজের পূর্ব গোদাবরী জেলায় গান্ধীজীর বক্তৃতা শুনতে বহু নারী সমবেত হয়েছিলেন। শ্রীমতি ধুবুরি সুরামান নারীদের নিয়ে ‘দেব সেবিকা’ সংগঠন গড়ে তুলতে সক্রিয় হন।

পূর্ব গোদাবরী জেলার কাঁকিনাড়াতে গান্ধীজী আসবেন এই সংবাদ শুনে হাজার ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে দূর্গাবাঈ নামে এক বারো বছরের বালিকা দেবদাসীদের সমবেত হতে বলেন।গান্ধীজী দেবদাসীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেশ ও আন্দোলনের স্বার্থে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এবং অর্থ সাহায্যের অনুরোধ করেন ।

প্রায় এক হাজার দেবদাসী নিজেদের গয়নাগাঁটি দান করার মাধ্যমে প্রায় কুড়ি হাজার টাকা দান করেন।

এই বিষয়ে আরো জানতে নীচের ভিডিওটি দেখুন ।

এবং চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন ।।

Last updated