অসহযোগ আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (১৯১৮খ্রিস্টাব্দ-১৯২৯খ্রিস্টাব্দ)।

অসহযোগ আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (১৯১৮খ্রিস্টাব্দ-১৯২৯খ্রিস্টাব্দ) ।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্বে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা হলেও ভারতে প্রকৃত সাংগঠনিক, রাজনৈতিক সচেতন, উপনিবেশ বিরোধী শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, আরো বলা ভালো দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ।

বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং কাজের অনিশ্চয়তা শ্রমিক আন্দোলনকে তীব্র করে তুলেছিল।

১৯১৭খ্রিঃ রুশ বিপ্লবের প্রভাব ভারতে শ্রমিক আন্দোলনকে প্রভাবিত কর্রেছিল । ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের পর কমিউনিস্ট মতাদর্শ এবং সংগঠনের প্রভাব পড়েছিল ।

জাতীয় কংগ্রেস ও শ্রমিক আন্দোলনের সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে কংগ্রেসের সাংগঠনিক বৃত্তে নিয়ে আনার প্রচেষ্টা শুরু হয় ।

শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের মনভাবঃ-

জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে বড় শিল্পপতিদের সমর্থন হারাতে চাননি । তবে যে সব কারখানার মালিক ইউরোপীয় সেখানে কংগ্রেস শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে আপত্তি করেনি ।

গোড়ার দিকে কংগ্রেস মনে করতো দ্রুত শিল্পায়ন হলো ভারতীয়দের দারিদ্র মোচনের একটি প্রধান উপায় ।

স্বয়ং গান্ধীজী পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন ।তিনি সরাসরি শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হতে চাননি ।এমনকি জাতীয় সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণির অংশগ্রহণের ব্যাপারে তার ঘোরতর আপত্তি ছিল ।তারমতে ভারতে শ্রমিক শ্রেণি ভীষণভাবে অসংগঠিত । তাদের মধ্যে যথেষ্ট প্রাদেশিকতা রয়েছে এবং তারা বেশ সাম্প্রদায়িক । যদিও গান্ধীজীর উথানে ১৯১৮ আমেদাবাদে সুতাকলে শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং তাতে গান্ধীজীর নেতৃত্ব সহায়ক হয়েছিল ।সুমিত সরকার বলেছেন ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বছর গুলিতে ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রকৃত সূচনা হয়েছিল।’

১৯১৯খ্রিস্টাব্দে রাওলাট আইনের প্রতিবাদে ভারতের শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে।

১৯১৮খ্রিস্টাব্দে অ্যানি বেসান্তের সহকর্মী চেলভাপাত চেট্টি মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন গঠন করেন।বি.পি.ওয়াদিয়া এর সভাপতি ছিলেন।

১৯১৯খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২০খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে কানপুর, জামালপুর,কলকাতা, বোম্বাই,শোলাপু্‌র, মাদ্রাজ, আমেদাবাদ,জামশেদপুর,প্রভৃতি শহরে বিভিন্ন কারখানা ধর্মঘট শুরু হয়।

১৯২০সালে বাংলায় শ্রমিক ইউনিয়নের সংখ্যা ছিল ৪০টি,১৯২১ও১৯২২খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ৫৫এবং ৭৫।১৯২০সালের দ্বিতীয়ার্ধে শুধু বাংলাতেই ১১০টি ধর্মঘট সংগঠিত হয়।

১৯১৯খ্রিস্টাব্দে এপ্রিলে পাঞ্জাবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতিবাদে এবং গান্ধীজীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আমেদাবাদ ও গুজরাটের শ্রমিকরা ধর্মঘট বিক্ষোভে সামিল হয়েছিল।সরকার বিদ্রহ দমনে নির্মম হয়ে ওঠে ২৮জন শ্রমিক নিহত ও ১২৩জন আহত হয়।

১৯১৯-২০ জামালপুর রেল ওয়ার্কশপে একাধিক ধর্মঘট হয়।১৯১৯খ্রীস্টাব্দে এপ্রিল মাসে উত্তর পশ্চিম রেলপথের শ্রমিকরা সর্বাত্মক ধর্মঘট ডেকেছিল।

বোম্বাইতে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের আগে শ্রমিক ইউনিয়ন বিভিন্ন নেতৃবৃন্দর সংখ্যা ছিল ৭টি।১৯২০থেকে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কমপক্ষে ২৯টি ইউনিয়ন গঠিত হ্য়।এইসময়ে শ্রমিক ইউনিয়ন গুলিতে বিভিন্ন মতাদর্শের নেতারা সামিল হয়েছিলেন ।একদিকে এন.এস.যোশীর মত নরমপন্থী নেতারা ছিলেন বোম্বাইতে। মাদ্রাজে ছিলেন ওয়াদিয়ার মত অ্যানি বেসান্তের অনুগামী নেতা । পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের তিলকপন্থী যুবনেতা । বাংলায় চরমমপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী প্রভাত কুসুম রায়চৌধুরী,বোমকেশ চক্রবর্তী, এস.এন.হালদার,জীতেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,হেমন্ত কুমার সরকার,এর মতে তরুণ নেতা । আবার স্বামী দর্শনানন্দ (রানীগঞ্জ)এবং স্বামী বিশ্বানন্দের (ঝরিয়া)মতো রাজনৈতিক সন্যাসীরা শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়ান । অন্যদিকে এস.এ.ডাঙ্গে, মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার মতো মাকর্সবাদী নেতারাও ছিলেন ।

আসামের চা বাগানের কুলিরা চা বাগান ছেড়ে পালিয়ে পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর অঞ্চলে হাজির হয়। তাদের ওপর গোর্খা সৈন্যরা অনেককে হত্যা করে। এই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদে ইস্টবেঙ্গল রেল ও স্টিমার কোম্পানির শ্রমিকরা ধর্মঘট করে।

১৯২১খৃস্টাব্দে নভেম্বরে শ্রমিক শ্রেণীর সংহতির এক চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোতে । ট্রাম শ্রমিক ও চটকল শ্রমিকদের যৌথ বিক্ষোভের মাধ্যমে। বিক্ষোভকারী শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষও হয়েছিল। এক ইউরোপীয় অফিসার কোলকাতার এক ডক শ্রমিকের মাথা থেকে গান্ধী টুপি খুলে নিলে প্রতিবাদে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ১৪ই ডিসেম্বর ধর্মঘট পালন করেন কলকাতার ৫০০০ ডক শ্রমিক।

A.I.T.U.C:-

শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯২০ খৃষ্টাব্দে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা । কারণ ১৯২০খ্রিস্টাব্দে ৩০শে অক্টবর ভারত ট্রেডইউনিয়ন কংগ্রেস বা A.I.T.U.C প্রতিষ্ঠা হয়।বোম্বাই শহরে । লালা লাজপত রায় ছিলেন সভাপতি দেওয়ান চমনলাল ছিলেন এর সাধারন সম্পাদক। সারা দেশে থেকে ৮০৬ জন প্রতিনিধি এই সমাবেশে যোগ দেন। এই ধরনের সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন লোকমান্য তিলক। অন্যান্য যে সব নেতারা এই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন তারা ছিলেন মতিলাল নেহেরু,বল্লভভাই প্যাটেল, অ্যানিবেসান্ত,জিন্না,যদিও অনুপস্থিতির তালিকায় ছিলেন মহত্মা গান্ধী ।

A.I.T.U.C এর সভাপতির ভাষনে লালা লাজপৎ রায় শ্রমিক শ্রেণিকে জানান যে শ্রমিকরা কিছুদিন বুদ্ধিজীবীদের সাহায্যে ও নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল থাকবে তার পর শেষপর্যন্ত তারা নিজেরাই নিজেদের নেতা খুঁজে বার করতে সক্ষম হবে।

জাতীয় কংগ্রেসের বহু বিশিষ্ট নেতা A.I.T.U.C এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যেমন চিত্তরঞ্জন দাশ, সি.এফ. এন্ড্রুজ যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, সুভাষ চন্দ্র বসু,জহরলাল নেহেরু, নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। A.I.T.U.C. এর তৃতীয় ও চতুর্থ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯২০সালে ১২৫টি ইউনিয়ন গড়ে ওঠে যার সদস্য সংখ্যা ছিল ২,৫০,০০০।

অন্যান্য শ্রমিক ধর্মঘটঃ-১৯২০খ্রিস্টাব্দে জামশেদপুরে টাটা ইস্পাত কারখানায় সুরেন্দ্রনাথ হালদারের উদ্যগে জামশেদপুরে লেবার অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়।

১৯২৩ সালের গোড়ার দিকে আমেদাবাদ বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকরা ২০শতাংশ মজুরি হ্রাসের প্রতিবাদে ধর্মঘট করেন।ধর্মঘটের ফলে আমেদাবাদে 64টি কারখানার মধ্যে 56টি বন্ধ হয়ে গেছিল।

1924খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বম্বের প্রায় দেড় লক্ষ বস্ত্রশিল্প শ্রমিক ধর্মঘট করেন।

ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টিঃ- ১৯২৫ এর পরথেকে সুভাষ চন্দ্র বসু,জহরলাল নেহেরু প্রমুখদের হাত ধরে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রসার শুরু হয়।১৯২৫খ্রিস্টাব্দে ১লা নভেম্বর বাংলায় কংগ্রেস দলের ভেতর ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ অব দ্যা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামে একটি দল প্রতিষ্ঠিত হয়।কাজি নজরুল ইসলাম,হেমন্ত কুমার সরকার,কুতুবুদ্দিন আহমেদ,সামসুদ্দিন হসেন,প্রমুখদের উদ্যগে।১৯২৬খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগরে আয়োজিত নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ এই দলের নতুন নামকরণ করেন’ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি অব বেঙ্গল’এর সভাপতি হন নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত এবং যুগ্ম সম্পাদক হন হেমন্ত কুমার সরকার, কুতুবউদ্দিন আহমেদ, কিছুদিনের মধ্যে যুক্ত প্রদেশ,বোম্বা্‌ই,পাঞ্জাব, প্রভৃতি প্রদেশে এই পার্টির শাখা গড়ে ওঠে।

Last updated