গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর ব্যঙ্গচিত্র।

ঠাকুর পরিবারে রবির আলোয় অনেকেই খানিকটা ম্লান হয়ে গিয়েছিলেন।কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং লিখেছিলেন ‘গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কেবা।’ গগন আসলে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে ছিলেন প্রচার বিমুখ এবং অন্তর্মুখী। তাই বোধহয় তাকে নিয়ে চর্চা এত কম।

গগনেন্দ্রনাথ বহু এবং বিচিত্র ছবি এঁকেছেন।কখনো প্রাচ্যধারায় নিসর্গচিত্র।জাপানি ওয়াশ পদ্ধতিতে মিস্টিক চিত্রকলা অথবা পাশ্চাত্য কিউবিক পদ্ধতিতে ‘দ্বারোকাপুরী’-মতো স্থাপত্যচিত্র।গগনেন্দ্রনাথ লিখতেন মূলত ছোটদের জন্য তার লেখা ‘ভোঁদরবাহাদূর’আজও সমান জনপ্রিয়। গগনেন্দ্রনাথ শুধু নাটকে অভিনয় করতেন না,পাশাপাশি মঞ্চসজ্জা, পোশাক পরিকল্পনা, নিজ দায়িত্বে করতেন।জাপানী শিল্পী ওকাকুরার মাধ্যমে জাপানী শিল্পরীতিতে দীক্ষিত হয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ।জাপানী কায়দায় জোড়াসাঁকোতে বাগান তৈরি করেছিলেন।ফার্নিচার বানিয়েছিলেন ভারতীয় ডিজাইনে। গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন দক্ষ সংগঠক,মূলত তার উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’।হস্তশিল্পদের এবং কুটির শিল্পীদের জন্য তৈরি হয়েছিল ‘বেঙল হোম ইন্ডাস্ট্রিজ’।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা গুণেন্দ্রনাথ এবং মহর্ষি পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের ছাত্র।মা সৌদামিনী দেবী ঘরোয়া হলেও তার শিল্প-চেতনা গৃহসজ্জা, কাঁথাস্টিচ, এমনকি সুপারি কাটার মধ্যে ফুটে উঠত।গগনেন্দ্রনাথ প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ছবি আঁকা শেখেননি।সেন্ট জেভিয়ার্সে ছাত্র থাকাকালীন ক্লাসে গগনেন্দ্রনাথ স্কেচ করতেন।বিদেশ থেকে দামী ক্যামেরা এনে ফোটোগ্রাফি শিখেছিলেন।

প্রথমদিকে গগনেন্দ্রনাথের ছবি আঁকা ছিল বিক্ষিপ্ত এবং সংক্ষিপ্ত।জ্যেষ্ঠপুত্র গেহেন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যুতে গগনেন্দ্রনাথ ভেঙ্গে পড়েছিলেন।পুত্রশোক ভোলার জন্য বাড়িতে কথকতার আয়োজন করা হয়েছিল।কথকের উপাখ্যান শুনতে শুনতে গগনেন্দ্রনাথ মন দেন কথক চূড়ামনির ছবি আঁকায়।এরপর প্রতিবেশী বা বাড়ির আত্মীয় স্বজনেরা তার ছবিতে নানা ভঙ্গিমায় ধরা পড়েছেন।

উদাসী গগনেন্দ্রনাথ কখনো কখনো খাবারের লোভে বাড়ির ছাদে,কার্নিসে,বারান্দার রেলিং-এ বসা কাক ও কাকেদের দলকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।পরে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কাকের সংকলনটি ‘Ten Indian Studies’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল।

এরপর গগনেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থচিত্রনে হাত দেন।চাইনিজ কালিতে প্রায় চব্বিশটি ব্রাশ ড্রয়িং-এ গগনেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর মানুষজন এবং অন্দরমহলকে ফুটিয়ে তোলেন অসামান্য দক্ষতায়।গগনেন্দ্রনাথ ‘প্রবাসী’ প্রকাশিত রক্তকরবীর প্রচ্ছদটি এঁকেছিলেন।কিউবিক রীতিতে যক্ষপুরীর রাজপ্রাসাদের জালিকাবরন তৈরি করেছিলেন।

গগনেনন্দ্রনাথ পুরী ভ্রমণের সময় চৈতন্যদেবের জীবন-লীলায় আকৃষ্ট হন।জলরঙে আঁকা চৈতন্য চিত্রমালার বেশকিছু ছবি ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ‘প্রবাসীতে’ প্রকাশিত হয়েছিল।

নিসর্গচিত্র অঙ্কনে গগনেন্দ্রনাথের নৈপুণ্য ছিল অতুলনীয়।পুরী, রাঁচি এবং দার্জিলিং পরিভ্রমণের সময় তার দৃশ্যচিত্রগুলি অপূর্ব সুষমায় মূর্ত হয়ে উঠেছিল।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো গগনেন্দ্রনাথ মুখচ্ছবি এবং প্রতিকৃতি অঙ্কনে ছিলেন দক্ষ।তবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো পেন্সিল নয় মূলত কালিতুলির সাহায্যে বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন।

গগনেন্দ্রনাথের বিস্ময়কর সৃষ্টি ছিল ‘রহস্যলোক’ সিরিজ।জাপানি এবং চীনা শিল্পীদের সাদা-কালো রীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব শিল্পশৈলী তৈরি করেন।এই চিত্রমালায় নারীরাই প্রাধান্য পেয়েছে,প্রায় প্রতিটি নারী অবগুণ্ঠিতা এবং রহস্যময়ী।স্টেলা ক্রেমরিশ এই চিত্রগুলিকে ‘মায়া সিরিজ’ নামে অভিহিত করেছেন।

গগনেন্দ্রনাথের প্রতিভা এবং চিন্তনের যথার্থ প্রকাশ ঘটেছিল ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুনে।ভারতে ব্যঙ্গচিত্রের প্রবর্তন হয়েছিল ইউরোপীয় শিল্পীদের হাত ধরে। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দিল্লী স্কেচবুক’।১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত ‘ইন্ডিয়ান পাঞ্চ’।ভারতীয় ‘পাঞ্চ’পত্রিকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ‘হিন্দি পাঞ্চ’।প্রথমদিককার এই ব্যঙ্গচিত্রগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ধর্ম সস্কৃতি,ব্যক্তি এবং রাজনীতিকে বিদ্রূপ করা।

গিরিন্দ্রনাথ দত্তকে বাংলার প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী বলা যায়।১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে অমৃতবাজার পত্রিকায় মিউনিসিপাল আইনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশিত হয় প্রথম বাংলা কার্টুন।বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশিত ব্যাঙ্গ-ধর্মী সাময়িকপত্র ছিল ‘বসন্তক’।এর প্রধান শিল্পী ছিলেন গিরিন্দ্রকুমার দত্ত।তবে রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ‘হিন্দিপাঞ্চ’।রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ‘মডার্ন রিভিয়ু’তে প্রকাশিত হয়েছিল।

গগনেন্দ্রনাথ পেশাদার ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী ছিলেন না।কিন্তু তার ব্যঙ্গচিত্র ‘প্রবাসী’, ‘মডার্ন রিভিয়ু’ ‘ভারতী’, ‘নারায়ণ’, ‘আগমনী’ ইত্যাদি নানা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।তার উল্লেখযোগ্য ব্যঙ্গচিত্র সংকলনগুলি ছিল ‘বিরুপবজ্র’(১৯১৭), ‘অদ্ভূতলোক’(১৯১৭), ‘নবহুল্লোড়’(১৯২১)।গগনেন্দ্রনাথ নিজেই তার ছবি ছাপার জন্য একটি পুরনো লিথোপ্রেস কিনেছিলেন।তার ব্যঙ্গচিত্রের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল একাধিকার।

গগনেন্দ্রনাথের ব্যঙ্গচিত্র জাতীয়তাবাদী ভাবধারা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল। গগনেন্দ্রনাথের মা সুনয়নী দেবী স্বদেশী চিন্তাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।গগনেন্দ্রনাথ নিজে সমসাময়িক বিভিন্ন বিপ্লবী-সমিতি এবং বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।অসহযোগ আন্দোলন, স্বরাজ্য দলের কার্যকলাপকে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।তার রাজনৈতিক চিন্তা এবং জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ প্রতিবিম্বিত হয়েছিল তার ব্যঙ্গচিত্রে।

বর্ণনা।

গগনেন্দ্রনাথ তার ব্যঙ্গচিত্রে বিদেশী সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণকারী ভারতীয় উচ্চবর্গের সমাজের সমালোচনা করেছেন।‘Hybrid Bangalessies’ নামের এই কার্টুনে ভঙ্গুর চীনা মাটির পাত্রের ওপর বিচিত্র পোশাক পরা নব্য-বাবুকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

অন্যদিকে ‘Find the Indian’ কার্টুনে তিনি ইউরোপীয় ক্লাবের সদস্যপদ পাবার জন্য ব্যগ্র সাহেবি অনুকরণপ্রিয় বাঙালীবাবুদের দেখিয়েছেন,যাদের দেখে মনে প্রশ্ন জাগে এদের মধ্যে সত্যিকারের ভারতীয় কোনজন?

আবার পুচ্ছ-পরিবর্তন কার্টুনে গগনেন্দ্রনাথ বার লাইব্রেরীতে কালো ভারতীয় এর সাদা সাহেব উকিল সাজার ব্যর্থ প্রচেষ্টাকে তুলে ধরেছেন।অনেকটা কাকের ময়ূর পালক জড়িয়ে ময়ূর হবার ব্যর্থ প্রচেষ্টার সঙ্গে তুলনা করে ব্যাঙ্গ করেছেন।

পাশাপাশি দুটি ব্যঙ্গচিত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি একদিকে বাঙালীবাবু রেলের কামরায় দেশী পোশাক পালটে সাহেব হবার চেষ্টা করছেন।অন্যদিকে ধুতি পাজ্ঞাবী পরিহিত শিক্ষিত বাঙ্গালীকে জনৈক ইউরোপীয় পোশাক পরা কৃষ্ণবর্ণ বাঙ্গালী অসম্মান করছেন।ট্রেনের কামরার দরজার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছেন।

গগনেন্দ্রনাথ রক্ষণশীল হিন্দু এবং হিন্দুধর্মের ভণ্ডামিকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করেছেন তার ব্যঙ্গচিত্রে।হিন্দুধর্মের আচার আচরণ সর্বস্বতা এবং অমানবিকতাকে তিনি ব্যাঙ্গ করেছেন।পাশাপাশি দুটি ব্যঙ্গচিত্র লক্ষ্য করুন।একটিতে পর্দা ফেলে কয়েকজন ব্রাহ্মণ একাদশীর দিন নিষিদ্ধ দ্রব্যাদি ভক্ষণ করছেন।এই ধরনের দৃশ্য গগনেন্দ্রনাথ একবার স্পেন্সেস হোটেলে দেখেছিলেন।

অন্যচিত্রে দেশী রাজা,পাঞ্জাবী হিন্দু,টিকি-ধারী ব্রাহ্মণ সাহেবি হোটেলে বিলিতি মাটন ভক্ষণ করছেন।জমিদার বাবু বেপরোয়া মদ্যপান করছেন।‘অন্তরালে যৎকিঞ্চিত’ নামে এই ব্যঙ্গচিত্রটি বার্ষিক বসুমতীতে (১৯২৫) প্রকাশিত হয়েছিল।

নির্জলা একাদশীতে পুরোহিত শাসিত আচার সর্বস্ব হিন্দু সমাজের বৈপরীত্যকে তুলে ধরেছেন।গগনেন্দ্রনাথ নিজে বিধবা মা সৌদামিনী এবং পুত্রবধূকে চোখের সামনে একাদশী উপবাস করতে দেখেছেন।ছবিতে একদিকে বাড়ির কর্তা এবং সধবা গিন্নি চর্ব্যচোষ্য ভাবে ভুঁড়ি-ভোজের মাধ্যমে একাদশী পালন করছেন।অন্যদিকে বাড়ির বিধবা প্রচণ্ড গরমে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে নির্জলা একাদশী পালন করছেন।

গগনেন্দ্রনাথ তার ব্যঙ্গচিত্রে অর্থলোভী এবং ক্ষমতালোভী ধর্মব্যাবসায়ী সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন।ভুঁড়ি সর্বস্ব ব্রাহ্মণ পুরোহিত টাকার বিনিময়ে পাপমোচন করেন অন্যদিকে ধর্মের নামে জমিয়ে ব্যবসা চলে।

গগনেন্দ্রনাথ তার ব্যঙ্গচিত্রে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে একদিকে নারীর অসহায়তা, অন্যদিকে পুরুষের উদাসীনতাকে তুলে ধরেছেন।পাশাপাশি দুটি ছবি দেখুন।একদিকে ভুঁড়িওয়ালা স্বামী সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে চলেছেন আর পেছনে বেচারা স্ত্রী কোলে বাচ্চা,বেডিং, ব্যাগ, মিষ্টি নিয়ে বাকী ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বামীকে অনুসরণ করছেন।

আর এই ছবিতে দেখতে পাচ্ছি প্রবল বৃষ্টিতে সাহেবি পোশাক পরিহিত বাঙ্গালী বাবু পোষা বিলিতি কুকুর নিয়ে ছাতা মাথায় সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন পাশে জনৈক মহিলা সম্ভবত তার স্ত্রী শিশু সন্তানসহ প্রবল বৃষ্টিতে ভিজছেন।

এই ব্যঙ্গচিত্রে গগনেন্দ্রনাথ বহুবিবাহ এবং বধূহত্যার নিদারুণ চিত্রকে তুলে ধরেছেন।প্রথম বউ মারা গিয়েছে সৎকার হয়নি,অথচ ঘরে দ্বিতীয় বউ হাজির।হাঁড়িতে যেমন কই মাছ জিয়ানো থাকে তেমনি পাত্রী জিয়ানো থাকে।

‘পতিদেবতা’ ব্যঙ্গচিত্রে লম্পট নেশাখোর স্বামীর পদতলে অসহায়া স্ত্রী।

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে বাগবাজারে চোদ্দবছরের বালিকা স্নেহলতা পণের হাত থেকে বাবাকে বাচাতে গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আত্মহত্যা করে।এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে একদিকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত,গোবিন্দ দাস কলম ধরেন,অন্যদিকে গগনেন্দ্রনাথ হাতে তুলে নেন তুলি ।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর সমসাময়িক বহু বিখ্যাত মানুষকে তার ব্যঙ্গচিত্রের বিষয়বস্তু করেছেন।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে।রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধি ত্যাগ করেন।অথচ বর্ধমানের মহারাজা সে বছর সি-আই-ই উপাধি গ্রহণ করেন।গভর্নর তাকে আতস কাঁচ দিয়ে খুঁজছেন।‘Congratulation you Maharaja, but down it. Where are you?’এই চিত্রে আসলে জাতীয়তাবোধের কাছে অজাতীয়ের ছোট হয়ে যাওয়া।

এই ব্যঙ্গচিত্রে স্ফীতোদর,কিমাকার ব্যক্তিটি হলেন বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব,যিনি বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে লম্বাচওড়া দেশাত্মবোধক ভাষণ দেন অথচ সাহিত্য-পরিষদের উন্নতির জন্য চাঁদা চাওয়া হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।হুঁকো-ধারী স্বদেশী গগনেন্দ্রনাথের কাছে তিনি কৌতুকের এবং বিদ্রূপের পাত্র।

সম্পর্কে গগনেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের ভাইপো।রবীন্দ্রনাথ বিমালে কলকাতা থেকে পারস্য যাওয়ার সময়কার বিষয়টিকে গগনেন্দ্রনাথ খানিকটা কৌতুকের সাথে চিত্রিত করেন। এবং নাম দেন ‘বাবুমশাই উড়িতেছেন’।

গগনেন্দ্রনাথের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন জগদীশচন্দ্র।জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করেন গাছেরও প্রাণ আছে।গগনেন্দ্রনাথ তাই ব্যঙ্গচিত্রে দেখালেন বাঁশগাছগুলি জ্যান্ত হয়ে চাঁদা আদায় করছে।লজ্জাবতী শেম শেম ধ্বনি দিচ্ছে,পদ্মফুল বন্দেমাতরম ধ্বনি দিচ্ছে।এই দুটি ছবিতে গগনেন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রের সূত্র ধরে দেখালেন একটি সাধারণ ফুল ধাপে ধাপে কপি অর্থাৎ বানরে পরিণত হচ্ছে অন্যটিতে ফুলকপিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

বেঙ্গল কেমিকেলে প্রফুল্লচন্দ্র আশ্চর্য কালি আবিষ্কার করেন যা জল লাগলে উঠবে না।আচার্য রায় শত চেষ্টাতেও অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদের কালিকে ধুয়ে সাফ করতে পারছেন না।

গগনেন্দ্রনাথ অন্তঃসারশূন্য ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার তীব্র সমালোচক ছিলেন।বিদ্যার কারখানা নামক ব্যঙ্গচিত্রে যান্ত্রিক পুঁথি-সর্বস্ব ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতাকে তুলে ধরেছেন।

বাক্‌যন্ত্র যন্ত্রের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে যান্ত্রিক ও প্রথা মাফিক ভাষণ তৈরির ব্যবস্থাকে তুলে ধরেছেন।

গগনেন্দ্রনাথের নিদিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল।যদিও সেটিকে কোন ছাঁচে ফেলা যায় না।তিনি যে কোনও রাজনৈতিক স্ববিরোধ এবং ভণ্ডামিকে তার ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে আক্রমণ করেছেন।

সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলেও তার আপোষমুখী সুবিধাবাদী রাজনীতিকে তিনি মেনে নিতে পারেননি।এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে একদা আদর্শবাদী ন্যাশনালিস্ট পার্টির অনুগামী সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী মন্ত্রিত্বের লোভে প্রো চেঞ্জার হয়ে গেলেন।দুই সাহেব সম্পাদকের কোলে বসে চকোলেট খাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য ও স্বায়ত্তশাসন দপ্তরের মন্ত্রী হয়ে সুরেন্দ্রনাথ সাহেবদের সমহারে চৌষট্টি হাজার টাকার বাৎসরিক বেতন দাবী করেন।গগনেন্দ্রনাথ ব্যঙ্গচিত্রে সুরেন্দ্রনাথকে চিত্রিত করলেন কর আদায়কারী পেয়াদার চেহারায়, যিনি লাঠি হাতে জীর্ণ কুটিরে বিধবা দরিদ্র জননীর কাছ থেকে তার পাওনা গণ্ডা বুঝে নিতে এসেছেন।

গগনেন্দ্রনাথ গান্ধীজীর চরকা রাজনীতি বিরোধিতা করেছিলেন।এই ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যাচ্ছে সব কিছু প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে,মাকড়শার জালে ঢাকা পড়ে গেছে, কিন্তু সবার ঊর্ধ্বে যাদু কার্পেটে চরকা উড়ে বেড়াচ্ছে।গগনেন্দ্রনাথ এই অবাস্তবতাকে কষাঘাত করেছেন।

গগনেন্দ্রনাথ অসহযোগ আন্দোলনের নেতিবাচক কর্মসূচীর ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ নেতারা সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রদের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান। তাদের মতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গোলদিঘির গোলামখানা।

এই ব্যঙ্গচিত্রে চিত্তরঞ্জন দাস এক ছাত্রের হাতে দেশলাই বাক্স ধরিয়ে দিচ্ছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুন লাগিয়ে দেবার জন্য।

অন্য ব্যঙ্গচিত্রে চিত্তরঞ্জন স্বয়ং অগ্নিসংযোগ করছেন তথাকথিত পুঁথি-সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় ।দেশলাই বাক্সে লেখা আছে NC অর্থাৎ non-cooperation.

আবার বিপরীত দিকে দেখা যাচ্ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় দমকল বাহিনীর পোশাকে আগুন নেভাতে ব্যস্ত।ভীমনাগের সন্দেশ এবং আমের ভক্ত আশুতোষ সন্দেশ ও আম দিয়ে NC দেশলাই বাক্স উড়িয়ে দিচ্ছেন এবং ছাত্রদের মুখে পুরে দিচ্ছেন।

অন্যএকটি ব্যঙ্গচিত্রে বাংলার গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারকে চিত্রিত করা হয়েছে।যার হাতে চাবুক।ফুলারকে বিকৃত,কিমাকার চেহারায় তুলে ধরা হয়েছে,তিনি আসলে শোষণ এবং অত্যাচারে প্রতীক যার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য মানুষ দিশেহারা হয়ে ছুটছে।

এইভাবে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক ভারতের অবরুদ্ধ এবং বিমূর্ত জাতীয়তাবাদকে মূর্ত করে তুলেছিলেন।স্বজন এবং স্বদেশ যখন আক্রান্ত হয় তখন শিল্পীকে তার গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয়।গগনেন্দ্রনাথ সারাজীবন তার জাগত সত্ত্বা এবং প্রতিবাদী শৈল্পিক স্বভাব ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

এই বিষয়ের ওপর ভিডিও লেকচার দেখার জন্য নীচের দুটি লিঙ্ককে ক্লিক করুন ।

Last updated