ফরাজী আন্দোলন ৷ faraizi movement ।
Last updated
Last updated
ইসলামের পুন:জাগরনমূলক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ওয়াহাবী আন্দোলনের মতো ফরাজী আন্দোলন ছিল উল্লেখযোগ্য৷ এই আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল পূর্ব্বঙ্গের ঢাকা,ফরিদপুর,ময়মনসিংহ ও বাখেরগঞ্জে৷
আরবি শব্দ 'ফারাইজ' থেকে 'ফরাইজি' বা 'ফারাজি' শব্দের প্রচলন হয়,যার অর্থ ইসলামের নির্ধারিত বাধ্যতামূলক ক`র্তব্য৷
ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পূর্ববঙ্গের মাদারিপুর মহকুমার সামাইল গ্রামের হাজি শরিয়তউল্লাহ৷ খুব সাধারণ পরিবারের সন্তান হাজি শরিয়ত`উল্লাহ অল্পবয়সে তার বাবা মাকে হারান৷ হাজি শরিয়ত`উল্লাহ একদিকে আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন৷ ১৮ বছর বয়সে তিনি মক্কায় তীর্থ ভ্রমনে যান এবং সেখানেই তিনি ওয়াহাবী আদর্শের সংস্পর্শে আসেন৷
দেশে ফিরে বাঙ্গালি মুসলমান সমাজের আত্মশুদ্ধির জন্য ফরাজি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন৷ শরিয়ত`উল্লাহ আদতে ছিলেন একজন ধ`র্মসংস্কারক৷ তিনি কোরানের একেশ্বরবাদকে অনুসরন এবং পৌত্তলিকাতাকে ব`র্জনের নির্দেশ দেন৷ কলমা,নমাজ,রোজা,জাকাৎ ও হজের ওপর গুরুত্ব দেন৷ শুধুমাত্র তাই নয় পীরের দরগায় বাতি দেওয়ার তিনি বিরোধীতা করেন৷
শরিয়ৎউল্লাহ ধ`র্মসংস্কারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও অন্যান্য শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সচেষ্ট থাকতো৷ জমিদার ও নীলকরদের শোষ ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি তার প্রচারকার্য চালাতেন৷
শরিয়ৎ উল্লাহ ফরিদপুর,বরিশাল,ঢাকা,নারায়নগঞ্জ,চাঁদপুর,কুমিল্লাতে ফরাজি আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয় করে তুলেছিল৷
দুদুমিঞা:
১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে শরিয়ৎ উল্লাহের মৃত্যু হলেও তার পুত্র মহ: মহসিন দুদুমিঞা ফরাজি আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তিনিও অল্প বয়সে মক্কা গিয়েছিলেন৷
দুদুমিঞা ফারাজি আন্দোলনকে ধ`র্মসংস্কার আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিনত করেন৷ তিনি তার অনুচরদের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেন৷ তিনি মহরম,বিবা ও মৃত্যু উপলক্ষে অহেতুক অর্থব্যায় এবং পির ও ফকিরদের উপাসনা বন্ধের নির্দেশদেন৷ দুদুমিঞা ঘোষনা করেন জমি আল্লাহর দান সুতরাং জমিদারদের খাজনা আদায়ের কোন অধিকার তার নেই৷ তিনি তার সমর্থকদের জমিদারদের খাজনা না দেবার,নীলকরদের নীলচাষ না কারার এবং বিদেশী ইংরেজদের না মানার আহ্বান জানান৷
ফরাজি আন্দোলনের দুটি দিক ছিল৷
১৷ তিনি 'ফরাজি খিলাফৎ' নামে একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন৷ এই ব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন ওস্তাদ এবং সাহায্যকারীকে বলা হতো খলিফা৷ তিনি তার প্রভাবাধীন এলাকাকে কয়েকটি হল্কায় বিভক্ত করেন৷ প্রত্যেক হল্কায় একজন খলিফা থাকতেন৷ খলিফাদের দায়িত্ব ছিল নিজ নিজ অঞ্চলের কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করা,জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা৷
২৷ সরকারী বিচারব্যবস্থা,কোর্ট ইত্যাদির বিপরীতে ফরাজিরা নিজেস্ব আদালত ও সালিশী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল৷ ফরাজি আদালতের বিচারকদের বলা হতো মুন্সি৷ এরা দেওয়ানি এবং ফৌজদারি দুই ধরনের মামলার নিস্পত্তি করতেন৷
ফরাজিরা বিচারব্যবস্থা,কোর্ট ইত্যাদির বিপরীতে ফরাজিরা নিজেস্ব আদালত ও সালিশী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল৷ ফরাজি আদালতগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল৷ হিন্দু-মুসলমান প্রজারা মনে করতো এই আদালতগুলি তাদের জমিদারের উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করবে৷
দুদুমিঞার জনপ্রিয়তা জমিদারদের শঙ্কিত করে তুলেছিল৷ ফরাজিদের গোহত্যা বন্ধ,কালীপূজা,এবং দূর্গাপূজার জন্য জোরজবরদস্তিমুলক কর আদায় করা হতো৷ ফরাজিরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে৷ দুদুমিঞা ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে কানাইপুরের জমিদার এবং১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুরেরজমিদার বাড়িতে হামলা চালান৷ দুদুমিঞা ও তার কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রমানের অভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়৷
দুদুমিঞা ও তার অনুগামীরা ফরিদপুরের নীলকুঠির ম্যানেজার ডানলপের নীলকুঠি ধ্বংস করেন৷
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সরকার শঙ্কিত হয়ে বিদ্রোহ দমনের নামে দুদুমিঞাকে বন্দী করে আলিপুর জেলে বন্দী রাখে৷ শেষ পর্যন্ত প্রমানের অভাবেমুক্তি দিতে বাধ্য হয়৷ অবশেষে ভগ্ন দেহে তিনি ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন৷
দুদুমিঞার মৃত্যুর পর তার পুত্র নোয়া মিঞার নেতৃত্বে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ফরাজিরা ফরিদপুর,বাখরগঞ্জ,মালদায় জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালিয়ে গিয়েছিলেন৷
ফরাজি আন্দোলন সফল হয়নি৷ তবে তাদের ব্যর্থতা আকস্মিক ছিল না ,এর কতগুলি কারণ ছিল৷
১৷ দুদুমিঞার মৃত্যুর পর ফরাজি আন্দোলন উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল৷
২৷ তিতুমীরের মতো দুদুমিঞা প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজবিরোধিতার পথে যায়নি৷ স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখেই চলতেন৷ জমিদার বা নীলকর বিরোধী হলেও ব্রিটিশ সরকারের ক্ষেত্রে ফরাজিরা ছিলেনা আপোষমুখী৷
3৷ এই আন্দোলন সংকীর্ণ ধ`র্মবোধ ও চেতনার ওপর গড়ে ওঠায় সমস্ত কৃষকশ্রেণির সমর্থন ও সহানুভুতি আদায় করতে পারেনি৷
৪৷ এই আন্দোলনের সুস্পস্ট পরিকল্পনা, কর্মসূচীর অভাব আন্দোলনের ভিত্তিভূমিকে দূর্বল করে দিয়েছিল৷
please click the link below to watch video lecture
ভিডিও লেকচারটি দেখার জন্য নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন ।