নীল বিদ্রোহ ৷ Indigo Revolt

কোম্পানির কৃষি বানিজ্যিকীকরণ ও বানিজ্যিক মুনাফালাভের প্রতিক্রিয়া হিসেবে চব্বিশ পরগণা,নদীয়া,হুগলি,বর্ধমান,মেদিনীপুর,যশোর,খুলনা,পাবনা,রাজশাহী সহ বাংলার বিশাল এলাকা জুড়ে নীল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল৷ প্রায় 60 লক্ষ কৃষক বলপূর্বক নীলচাষ এবং নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে সবার্ত্মক বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল৷

সবচেয়ে মজার কথা তাদেরেই বিদ্রোহকে জমিদার,মহাজন,তালুকদার,পত্তনিদাররা সমর্থন করেছিল এমনকি বিদ্রোহে সাহায্য করেছিল ৷ মিশনারীরা বিদ্রোহীদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল, এমনকি কোম্পানি ও প্রশাসনের ক র্তাব্যক্তিরা নীলকর,সাহেবদের বিরুদ্ধে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছিল৷ সর্বোপরি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি নীলবিদ্রোহ নিয়ে যথেষ্ট মাতামাতি করেছিল৷ তাই সার্বিকভাবে নীল বিদ্রোহের প্রক্ষাপট এবং চরিত্র অন্য কৃষক বিদ্রোহ থেকে আলাদা ছিল৷

নীল কি? এবং নীলের গুরুত্ব বৃদ্ধির কারণ৷

নীল শুধু রং নয় নীল একধরনের গাছ ৷ যার বৈজ্ঞানিক নাম 'Indigo feral Linctoria' সংক্ষেপে বলা হতো Indigo এটি মূলত রঞ্জনদ্রব্য বা cloth dyers বস্ত্র বা কাপড় শুধু সাদা নয় রঞ্জিত করার জন্য ব্যবহৃত হতো ৷

লুই বন্নো নামেএকজন ফরাসি 1772 খ্রিস্টাব্দে পূর্বভারতে নীলচাষ ও কুঠি নির্মাণে উদ্যোগী হন৷ ক্যারল ব্লুম নীলচাষের বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জনের ব্যাপারটি স র্বজন সমক্ষে তুলে ধরে ৷

ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের দরুন বস্ত্রবয়ন শিল্পে জোয়ার আসে তার দরুন নীলের চাহিদ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়৷ অন্যদিকে আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ ফরাসি বিপ্লবের ফলে আমেরিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে ইংল্যান্ডে নীলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়৷

ফলে ইংল্যান্ডের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের নজরে পড়ে ভারতে৷ এমনকি কোম্পানি নিজেও বাংলায় নীল চাষের বিস্তার ও নীলকুঠি নির্মাণে উৎসাহ প্রদানে হয়ে উদ্যোগী হয়ে উঠেছিল৷ ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি দশজন অগ্রগ্রামী নীলকরদের নীলচাষের জন্য অগ্রিম অর্থ প্রদান করেছিল৷

গুনগতদিক দিয়ে বাংলার নীল মূলত নদীয়া যশোহরের নীল ছিলসেরা৷ শুধুমাত্র ইংল্যান্ড থেকেই আগত নীলকর সাহেব নয় কোম্পানির উচ্চপদস্থ ক র্মচারীরা নীলচাষে বিনিয়োগকরা শুরু করে৷ তাদের দেখাদেখি এদেশের ধনীব্যক্তিরা মুনাফা লাভের আশায় নীলচাষে আগ্রহী হয়ে ওঠে৷ যেমন দ্বারকানাথ ঠাকুর, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়,রামরতন রায় প্রমুখরা লাভের আশায় নীল চাষে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন৷ একটা পরিসংখ্যান অনু্যায়ী দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে ১৭৮৮ নাগাদ ব্রিটেনে ভারত থেকে আমদানিকৃত নীলের পরিমান ছিল মোট আমদানির ৩০ শতাংশ৷ ১৮১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই পরিমান বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯৫ শতাংশ৷

নীলবিদ্রোহের প্রেক্ষাপট৷

নীলচাষের পদ্ধতিগত দিক : ভারতে নীল চাষের ক্ষেত্রে কোম্পানি প্রথমে 'নিজ আবাদ' এবং পরে 'রায়তি পদ্ধতি' অনুসরন করেছিল৷

নিজ আবাদ: নিজ আবাদের ক্ষেত্রে নীলকরদের জমি কিনতে হতো বা লিজ নিতে হতো জমিদারদেরর কাছ থেকে৷ কৃষক শ্রমিকদের জোগাড় করে তাদের দিয়ে নীলচাষ করাতে হতো৷ কিন্তু নিজ আবাদ পদ্ধতি মোটেই লাভজনক ছিল না৷

কারণ: ১৷ নীলচাষের জন্য জরুরিইছিল নীলকুঠি সংলগ্ন উর্বর জমি৷ কিন্তু ব্যাপক পরিমান উর্বর জমি জোগাড় করা ছিল কঠিন কাজ৷

২৷ নীল চাষের জন্য যে প্রচুর সংখ্যায় কৃষক-শ্রমিক প্রয়োজন ছিল তা ধান চাষের মরশুমে জোগাড় করা ছিল কঠিন কাজ৷

৩৷ মোটামুটি হিসেব অনু্যায়ী ১০০০ বিঘা নীল চাষের জন্য ২০০০টি লাঙল প্রচুর ষাঁড়ের প্রয়োজন ছিল য জোগাড় করা ছিল বেশ সমস্যার৷

ফলত নিজ আবাদ পদ্ধতি জনপ্রিয় হতে পারেনি প্রায় ২৫ শতাংশ নীল চাষের জমি ছিল নিজ আবাদ এর আওতায়৷

রায়তি ব্যবস্থা:

রায়তি ব্যবস্থায় নীলকরদের সঙ্গে নীলচাষ বা রায়তদের চুক্তি হতো৷ নীলচাষের জন্য রায়তকে অগ্রিম অর্থ বা 'দাদন' দেওয়া হতো বং সাথে বীজ ও অন্যান্য সামগ্রী৷ চাষী তার মোট জমির কমপক্ষে পঁচিশ শতাংশ নীলচাষ করতে বাধ্য থাকতো৷ নীল ফলানোর পর রায়ত পুনরায় অগ্রিম পেতো৷

ঐতিহাসিকদের মতে নগদ টাকা বা দাদনের টানে চাষীরা শুরুর দিকে নীল চাষে আকৃষ্ট হয়েছিল৷ কিন্তু শীঘ্রই তারা নীলচাষের সর্বগ্রাসী রূপের পরিচয় পেয়েছিল৷

নীলবিদ্রোহের প্রেক্ষাপট৷

দামে প্রতারনা:

বিঘা প্রতি মাত্র দুটাকা খরচ করে নীলকর তুলে নিতেন বারো টাকা৷ তার থেকে চাষী৷ পেতেন মাত্র ২.৫০ টাকা ৷ আসলে চাষীরা নগদ অর্থের লোভে নীল চাষ করতে এগিয়ে যেতো৷

উর্বর জমিতে নীল চাষে বাধ্য করা:

নীলকররা চাষীকে বাধ্য করতো অপেক্ষাকৃত ভালো জমিতে নীল চাষ করতে বাধ্য করত,যেখানে ধান চাষ করা ছিল চাষীর পক্ষে অধিক লাভজনক৷ দ্বিতীয়ত বেশ কয়েক বছর নীল চাষ করলে উর্বর জমি ক্রমে অনুর্বর হয়ে পড়তো৷

ধান চাষের সুবিধা থেকে বঞ্চিত:

চাষীরা ধান চাষ করলে জমিদারের প্রাপ্য মিটিয়েও বাকি অংশ খোরাকি হিসেবে ব্যবহার করতো বা স্বাধীনভাবে বাজারে বিক্রি করতে পারতো৷ নীলচাষের প্রাবল্য বৃদ্ধির ফলে বাজারে ধানের দাম বৃদ্ধি পেতে শুরু করে৷

বলপূর্বক নীলচাষ:

উপরিউক্ত কারণের দরুন চাষীরা নীলচাষে রাজি হতো না আর তখনি তাদের লাঠিয়াল দিয়ে ধরে এনে নীলচুক্তিতে জোর করে সই করানো হতো এবং দাদন নিতে বাধ্য করা হতো৷ বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া ধানের চারা উপরে ফেলা সহ বিভিন্ন শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো৷

জমিদারদের ক্ষোভ:

মাথায় রাখতে হবে নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাঝারি ও ছোট জমিদারেরা

কারণ: ১/ নিজ আবাদি ক্ষেত্রে বহু জমিদার অপেক্ষাকৃত কমদামে নীলকরদের জমি বিক্রি বা লিজ দিতে বাধ্য করেছিল৷

২/ নীল চাষের পরিপ্রেক্ষিতে জমিদার ও তার রায়তদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল৷ জমিদারদের স্বাধিকারে নীলকররা ৷হস্তক্ষেপ করত৷

৩/ ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে নীলকরদের সম্পর্ক ভালো হওয়ায় জমিদারেরা আদালতের দারস্থ হতেন না৷

পঞ্চম আইনের প্রভাব:

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে কুখ্যাত 'পঞ্চম' আইন ঘোষনা করা হয় দাদনগ্রহনকারী চাষী নীল চাষে অনিচ্ছুক হলে তার বিরুদ্ধে নীলকর সাহেব ফৌজদারি অভিযোগ করতে পারবেন৷ অভিযোগ প্রমানিত হলে কৃষক্কে কারাদন্ড ভোগ করতে হবে৷ এই আইনের অপপ্রয়োগ করে অনিচ্ছুক কৃষকদের নামে মামলা ও গ্রেপ্তারির পরোয়ানা জারি করা হয়৷

ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক ফেলের ঘটনার প্রভাব:

মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে নীলের বাজারে মন্দা দেখা দেয়৷ ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনিয়ন ব্যঙ্ক ফেল পরায় নীলকরদের পুঁজিতে টান পড়ে কারন এই ব্যঙ্কই ছিল নীলকরদের পুঁজির উৎস৷ ফলত তারা কম দামে চাষীদের নীল চাষ করতে বাধ্য করেছিল৷ ব্লেয়ার কিং তার গ্রন্থে দেখিয়েছেন ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করলে তার আয় হতো সাত টাকা অন্যদিকে নীল চাষ করলে আয় হতো এক-তৃতীয়াংশের কম৷

নীলকরদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী জনমত:

'হিন্দু পেট্রিয়ট'' সংবাদ প্রভাকর','গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা', 'সোমপ্রকাশ' প্রভৃতি পত্রিকায় নীলচাষীদের অত্যাচার এবং কৃষকদের দুর্দশার সংবাদ ও নীল চাষীদের প্রতি বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সহানুভুতি কৃষকদের প্রতিবাদে সাহস জুগিয়েছিল৷

মিশনার ও সরকারী হস্তক্ষেপ:

মিশনারীরাও নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল৷ সাহেবদের অত্যাচার ও শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল৷১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল লতফ এবং ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ম্যাঙ্গেলস বলপূর্বক নীলচাষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনে এগিয়ে এলে রায়তরা সাহসী হয়ে ওঠে এবং নীল চাষ বন্ধ করে দেয়৷ বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট এডেন একটি পরোয়ানা জারি করে বলেন চাষীরা তাদের জমিতে কি ফসল উৎপাদন করবে তা তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার৷

নীল বিদ্রোহের সূচনা ও বিস্তার৷

প্রথম প র্বে নীলচাষীরা নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ প্রশাসক ম্যাজিস্ট্রেট এবং আদালতের শরনাপন্ন হয়েছিল৷

দ্বিতীয় পর্বে:

নদীয়া যশোহর,পাবনা,রাজশাহী,মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন অঞ্চলে নীলচাষ না করার সংকল্প নেয়৷ নীলকর ও তার কর্মচারীদের ধোপা, নাপিত, পাচক বন্ধ করে একঘরে করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল৷

তৃতীয় পর্বে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে দশ আইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে নীলকরেরা খাজনা বাড়াতে শুরু করলে কৃষকরা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়৷ তারা আদালতের শরনাপন্ন হয়েছিল৷ এমনকি নীলকরদের পক্ষে সাক্ষ্যদিতে আদালতে কেউ হাজির হতো না৷

শেষ পর্বে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস থেকে নদীয়া,যশোহর,বারাসাত,পাবনাতে কৃষকরা নীলকুঠিগুলিকে আক্রমণ করতে শুরু করে৷

Please click the link below to watch the video lecture.

ভিডিও লেকচারটি দেখার জন্য নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন ।

Last updated