চুয়াড় বিদ্রোহ। Chuar revolt.
Last updated
Last updated
মেদিনীপুর জেলার উত্তর পশ্চিম অঞ্চল, বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল,মানভূমের পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ এলাকায় ১৭৬৮-৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৯৮-৯৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে দুটি পর্বে চুয়াড় বিদ্রোহ হয়েছিল ।
চুয়াড় কারা?-
প্রথমেই আমাদের জানতে হবে চুয়াড় কাদের বলা হতো ।চুয়াড় শব্দটি খুব একটা ‘ভদ্র’ শব্দ নয় ।সাধারণত উপরিউক্ত অঞ্চলের আদিবাসীদের ইংরেজ প্রশাসকরা চুয়াড় বলতো ।এরা মূলত ভূমিজ,কূর্মি,বাগদী সাঁওতাল,কোড়া,মুন্নারি ইত্যাদি উপজাতিভুক্ত ।চুয়াড়রা শুরুর দিকে ঝুমচাষ,পশুপালন,পশু-শিকার এবং জঙ্গলের দ্রব্যাদি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো তবে পরে চুয়াড়দের একটা বড় অংশ মুঘলদের অধীনে জমিদারদের সৈন্যবাহিনীতে কাজ করতো। এদের পাইক বলা হতো ।ফলত এরা তীর,ধনুক,বর্শা,টাঙ্গী চালনায় পারদর্শী ছিলো ।এমনকি কেউ কেউ বন্দুক চালাতে জানতো ।
চুয়াড় বিদ্রোহের নেতা-নেতৃবৃন্দ-
১৭৬৮ ক্রিস্টাব্দে ঘাটশিলার জমিদার বা ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিং প্রথম স্থানীয় জমিদারদের সাহায্যে বিদ্রোহে ঘোষণা করেন ।প্রায় ৫০ হাজার চুয়াড় এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন ।
১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে ধাদকার শ্যাম গঞ্জনের নেতৃত্বে পুনরায় চুয়াড়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
তবে দ্বিতীয় পর্বে (১৭৯৮খ্রিঃ -১৭৯৯খ্রিঃ)চুয়াড় বিদ্রোহ সবচেয়ে বেশী তীব্র হয়ে উঠেছিল রায়পুরের জমিদার দুর্জন সিং এর নেতৃত্বে । কয়েক হাজার বিদ্রোহী চুয়াড় রায়পুর পরগণার ওপর আধিপত্য কায়েম করে।চন্দ্রকোনার পাইক সেনাপতি গোবর্ধন দিকপতিও বিদ্রোহ করেছিলেন ।যদিও এই বিদ্রোহ দমন করা সহজ হয়েছিল ।দুর্জন সিংহকে গ্রেপ্তার করা হয় । পরে প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস করা হয় ।
জঙ্গলমহলে চুয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণি ।রাণী শিরোমণির প্রধান ঘাঁটি ছিলো বাহাদুরপুর,শালবনি ও কর্ণগড়।ইংরেজ সরকার রাণী শিরোমণি সহ কয়েকজনকে বন্দী করে কর্ণগড় ও আবাসগড় দুর্গ সরকার দখল করে নেয় । ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের গোড়ায় রাণী শিরোমণি ও তার নায়েব চুনি লাল খাঁকে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে ছেড়ে দেওয়া হয় ।
চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ ও প্রেক্ষাপট ।
উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকার আদিবাসী গোষ্ঠীপ্রধান এবং শাসকদের মুঘল সম্রাটরা খুব একটা বিব্রত করতেন না ।তারাও নামমাত্র কর দিয়ে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতো ।তাদের মধ্যে কয়েকজনের রাজা উপাধিকারী ছিলেন ।এদের অধীনে থাকতো পাইক সেনাবাহিনী। মুঘল সীমান্ত অঞ্চলের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকতেন । বিনিময়ে নিষ্কর জমি বা পাইকন ভোগ করতেন ।
মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান হলে কোম্পানির আমলে পাইকদের দায়িত্বের অবসান ঘটে । পাইকান জমি বাজেয়াপ্ত করে খাজনার আওতায় নিয়ে আসা হয় । ফলে বহু পাইক কাজ হারিয়ে ও পাইকান জমি হারিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে । এরাই জমিদারদের সঙ্গে বিদ্রোহ যোগ দিয়েছিলেন ।
চুয়াড় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছোট বড় জমিদারেরা যেমন রাইপুরের জমিদার দুর্জন সিং, মেদিনীপুরের জমিদার রাণী শিরোমণি, ঘাটশিলার জমিদার রাণী জগদ্দল ধল,মানভূমের জমিদার বীর সিং প্রমুখরা। এখন প্রশ্ন হলো জমিদারশ্রেণি কি কারণে বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ।
আসলে কোম্পানি শুরুর দিকে চোয়াড়দের জমিগুলিকে জমিদারদের এবং ইজারাদারদের হাতে তুলে দিয়েছিলো ।প্রথম দিকে রাজস্বের পরিমাণ সীমিত থাকলেও থাকলেও ক্রমে রাজস্বহার বৃদ্ধি পেয়েছিল ।শর্ত অনুযায়ী বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বহু জমিদার জমা করতে অসফল হয় ।ইংরেজ শাসকরা তাদের সৈন্যসামন্ত দিয়ে ঐ সমস্ত জমি কেড়ে নেয় ।এবং অন্য ব্যক্তির কাছ উচ্চমূল্যে ইজারা দেয় ।ফলত জমি হারিয়ে জমিদারেরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল । ফলত এই সব বিক্ষুব্ধ জমিদারেরা বিদ্রোহী চোয়াড় ও পাইকদের নেতৃত্বদানে এগিয়ে এসেছিল ।
এইভাবে জমিদার, চোয়াড় এবং পাইকদের সম্বলিত প্রতিরোধে চোয়াড় বিদ্রোহ তীব্র হয়ে উঠেছিল ।
চোয়াড় বিদ্রোহের গুরুত্ব বা প্রভাব ।
ডঃ শশিভূষণ চৌধুরী চোয়াড় বিদ্রোহ প্রসঙ্গে বলেছেন ‘ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জমিদার ও তার অনুচরদের সংগ্রাম ছিল । কিন্তু প্রজারাও যে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধী ছিলেন তাও বোঝা যায়’
বিদ্রোহীদের আক্রমণের ফলে ‘জঙ্গলমহলে’ অর্থাৎ যে সব অঞ্চলে পাইক ও চোয়াড়দের কাছ থেকে জমিজমা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সে সব অঞ্চলে পাইক ও চোয়াড়দের কাছ থেকে জমিজমা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সে সব অঞ্চলে রাজস্ব আদায় বন্ধ হয়ে যায়।‘
সমসাময়িক নথি এবং ইংরেজ অফিসার ও কালেক্টরদের নথি থেকে জানা যায় যে গ্রামাঞ্চল জন-মানবহীন হয়ে গিয়েছিল ।বিদ্রোহীরা চাষিদের গরু-বাছুর তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল ।
চোয়াড় বিদ্রোহ দমন করার জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন দুধরণের বিভেদনীতির আশ্রয় নিয়েছিল ।
ক। ১।জঙ্গলমহলে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব জমিদারদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
২।সরকার ঘোষণা করে রাজস্ব বাকি পড়লে ‘জঙ্গলমহলের’ জমিদারি আর বিক্রি করা যাবে না ।
খ। অন্যদিকে সরকার বুঝতে পারে পাইকদের জমি বলপূর্বক দখল করা অনুচিত হয়েছে ।
১।ফলত নামমাত্র খাজনার বিনিময়ে পাইকদের জমি ফেরৎ দিয়ে দেওয়া হয় ।তবে শর্ত দেওয়া হয় চুয়াড়রা কোন রকম অস্ত্র রাখতে পারবে না।
২। মেদিনীপুর অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মেদিনীপুরের কালেক্টর চুয়াড় ও পাইকদের ব্যাপকভাবে পুলিশের চাকরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন ।
৩। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে সরকারি উদ্যোগে মেদিনীপুর,বাঁকুড়া,বীরভূম মানভূম ইত্যাদি অঞ্চল নিয়ে ‘জঙ্গলমহল’ নামে স্বতন্ত্র জেলা গড়ে উঠেছিল ।
৪। সবচেয়ে বড়কথা চুয়াড় বিদ্রোহ পরবর্তী কৃষক এবং উপজাতি বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের অনুপ্রেরণা এবং সাহস যুগিয়েছিল। ৫।আজও মেদিনীপুর অঞ্চলে চুয়াড় বিদ্রোহীদের সাহস এবং সংগ্রাম মানুষ সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করে ।রাণী শিরোমণি কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে ।
Please click the link below to watch Video Lecture.
চুয়ার বিদ্রোহের ওপর ভিডিও লেকচারের জন্য নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।